তাকে নিয়ে এখন অনেক কথা। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা। কবি সুকান্ত বহুকাল আগে লিখে গেছেন-‘তোমরা এসেছো, ভেঙেছো অন্ধকার, তোমরা এসেছো, ভয় করি নাকো আর। পায়ের স্পর্শে মেঘ কেটে যাবে, উজ্জ্বল রোদ্দুর। ছড়িয়ে পড়বে বহুদূর...বহুদূর।’
Advertisement
তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই কবিতার পংক্তিগুলো যদি এখন কেউ হামজা চৌধুরীকে নিবেদন করেন, তাহলে কি খুব ভুল হবে? বাড়াবাড়ি হবে?
নাহ, মনে হয় মোটেই বাড়াবাড়ি মনে হবে না। কারণ খাদের কিনারায় পড়ে থাকা দেশের ফুটবল যে এখন হামজা চৌধুরীর হাত ধরেই আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে! ইংলিশ ফুটবলের পরিচিত মুখ হামজা চৌধুরী এখন বাংলাদেশের ফুটবলে সেই কাব্যলোকের রাজকুমার। তাকে নিয়ে দেশের ফুটবলে এসেছে নতুন জাগরণ।
যে প্রজন্ম ক্রিকেটের উত্তরণ আর ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, মহাদেশীয় পর্যায়ে বারবার ব্যর্থতার কারণে ফুটবল থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছিল; সেই নতুন প্রজন্ম আবার ফুটবলকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
Advertisement
হামজা চৌধুরীর পা ও মাথার ওপর ভর করে দেশের ফুটবল আবার জাগবে, তলানিতে থেকে উঠে আসবে; সে স্বপ্ন এখন প্রতিটি ফুটবল অনুরাগীর। তাইতো মাঠবিমুখ দর্শক আবার টিম বাংলাদেশের খেলা দেখতে মরিয়া।
বাংলাদেশ আর সিঙ্গাপুরের ম্যাচ দেখতে সাজ সাজ রব। রীতিমত সাড়া পড়ে গেছে। কোরবানির ঈদের আগে গরু, ছাগল কেনার হিড়িক পড়ে যায় প্রতিবার। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ আর সিঙ্গাপুর ফুটবল ম্যাচের টিকিট কেনার হিড়িক। তরুণ প্রজন্মের মুখে একটাই কথা, ইংলিশ ফুটবলের পরিচিত মুখ হামজা চৌধুরীর খেলা দেখবো। তার জাদুকরি ফুটবল নৈপুণ্যে বাংলাদেশের ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় দেখতে চাই।
তরুণরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। টিকিট কেটে ১০ জুন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে বসে হামজার চৌধুরীর নৈপুণ্য চোখে দেখতে মরিয়া লাখ ফুটবল অনুরাগী। বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচের টিকিট কিনতে মরিয়া ফুটবল অনুরাগীদের একাংশ বাফুফে ভবনের সামনে অবস্থানও নিয়েছে।
অথচ মাঠবিমুখ দর্শকরা উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন ক্রিকেটে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ মানেই ছিল দর্শকদের উন্মাদনা। আকর্ষণীয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট আসর দেখতে গালে-হাতে উল্কি এঁকে শেরে বাংলায় ভিড় জমিয়েছেন দেশের ক্রীড়া অনুরাগীদের বড় অংশ। খেলাপ্রেমীদের কলতানে মুখর হয়ে থেকেছে হোম অব ক্রিকেট। আর ইতিহাসের অনেক বড় বড় ঘটনার সাক্ষী, সোনালী সাফল্যের ভেন্যু হয়েও অন্তরালে পড়ে গিয়েছিল ক্রীড়া কেন্দ্র ও ক্রীড়া তীর্থ ঢাকা স্টেডিয়াম।
Advertisement
বড় অনাদর, অবহেলা ও অবমূল্যায়িত হয়েছে ঢাকা স্টেডিয়াম। এর মধ্যে আবার ৫৫ মাস ছিল খেলা বন্ধ। সংস্কার, পুণঃনির্মাণ এবং পুরো স্টেডিয়ামে নতুন ছাদ ও ফ্লাডলাইল লাগানোর কারণে দীর্ঘ সময় খেলা হয়নি ঢাকা স্টেডিয়ামে। সব মিলে প্রায় ৬ বছর ধরে প্রাণ নেই ঢাকা স্টেডিয়ামে।
দীর্ঘ সময় খেলা না হওয়া, পাশাপাশি জাতীয় দলের সাফল্যহীনতায় আলো কমেছে ঢাকা স্টেডিয়ামে। নিজ জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক সাফল্য যদিও কম, তারপরও বিশ্বমানের দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত খেলা হওয়ার কারণে হাজার হাজার দর্শক ঠিক শেরে বাংলায় ছুটে গেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে।
ক্রিকেট দেখতে দেখতে বর্তমান প্রজন্মের একটা বড় অংশ ধরেই নিয়েছে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামই বুঝি দেশের খেলাধুলার প্রধান ভেন্যু। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়।
ঢাকা স্টেডিয়ামের ইতিহাস অনেক পুরোনো। অনেক সমৃদ্ধ। এ মাঠের গুরুত্ব, মর্যাদা আর ঐতিহ্য বহুগুণে বেশি। ঢাকা স্টেডিয়ামে টিম বাংলাদেশের অর্জন, সাফল্য ও কৃতিত্বও যে বহু।
পাকিস্তান আমলে দুই পাকিস্তানের এক নম্বর ভেন্যু হিসেবেই সমাদৃত ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ভেন্যু যে মাঠে ২ দেশের টেস্ট অভিষেক ঘটেছে। পাকিস্তান টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে প্রথম টেস্ট খেলেছে এই ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে। আর ২০০০ সালে বাংলাদেশ অভিষেক টেস্ট ম্যাচে অংশ নিয়েছে এই ঢাকা স্টেডিয়ামেই। প্রতিপক্ষ সেই ভারত।
এছাড়া আরও একটি ক্রিকেট আসরের কথা না বললেই নয়; সেটা হলো ১৯৯৮ সালের মিনি বিশ্বকাপ। যাকে নকআউট বিশ্বকাপও বলেন অনেকে। বাংলাদেশ তখনো টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি।
টেস্ট মর্যাদা পাওয়া ৯ দেশকে নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে হয় নকআউট ওয়ার্ল্ডকাপ। এক শহরে ৯টি টেস্ট খেলুড়ে দেশ ছিল এক সপ্তাহের বেশি সময়। ওই নকআউট টুর্নামেন্টের সবকটা খেলা হয়েছে ঢাকা স্টেডিয়ামে। অতবড় আসর এক মাঠে সফল আয়োজনের রেকর্ড নেই বললেই চলে। তবে ঢাকা স্টেডিয়াম ১৯৯৮ সালে নকআউট টুর্নামেন্টের সবকটা ম্যাচের আয়োজক হয়ে রীতিমত এক বড় ঘটনার জন্ম দেয়। ওই আসরের তাৎপর্য একটাই। সেটা হলো, ক্রিকেটে এখনকার ‘চোকার’ দক্ষিণ আফ্রিকার শিরোপা জয়। ক্রিকেটের কোনো বিশ্ব আসরে প্রোটিয়ারা একটি শিরোপাই জিতেছে। সেটা ওই ১৯৯৮ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে হওয়া মিনি ওয়ার্ল্ডকাপে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট সমর্থকদের মনেও ঢাকা স্টেডিয়ামের নামটা গেঁথে আছে।
এছাড়া ঢাকা স্টেডিয়ামের রয়েছে বর্ণাঢ্য রূপ। সম্ভবত ঢাকা স্টেডিয়ামই হলো বিশ্বের একমাত্র স্টেডিয়াম, যার ‘একই অঙ্গে এত রূপ।’ যেখানে ফুটবল, ক্রিকেটের পাশাপাশি হকির আন্তর্জাতিক তথা মহাদেশীয় আসর বসেছে। এর বাইরে পেশাদার কুস্তি এবং সাইক্লিং ও অ্যাথলেটিকসও হয়েছে অনেক।
কেউ কেউ হয়তো অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের নাম বলবেন। মেলবোর্ন মাঠেও ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবল ও রাগবি খেলা হয়। কিন্তু ক্রিকেট, ফুটবলের পাশাপাশি হকি, কুস্তি, অ্যাথলেটিকস ও সাইক্লিং হওয়ার রেকর্ড হয়তো নেই আর কোনো স্টেডিয়ামের।
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, ১৯৫৫ সালে (১-৪ জানুয়ারি) এই ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ক্রিকেট দল দেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচটি খেলে। আব্দুল হাফিজ কারদারের অধিনায়কত্বে লিটল মাস্টার হানিফ মোহাম্মদ, পাকিস্তান ক্রিকেটের প্রথম উইকেটকিপার ডাবল সেঞ্চুরিয়ান ব্যাটার ইমতিয়াজ আহমেদ আর পেসার ফজল মাহমুদে সাজানো ছিল দল।
অন্যদিকে ভীনু মানকাদের নেতৃত্বে ভারতীয় দল তখন টেস্ট ক্রিকেটের দেড়শ বছরের ইতিহাসে প্রথম উইকেট জুটির বিশ্বরেকর্ডের অন্যতম স্রষ্টা পঙ্কজ রায়, বিজয় মাঞ্জেরকার, পলি উমরিগর, দাতু ফাতকার ও সুভাষ গুপ্তের মত প্রতিষ্ঠিত ও নামী পারফরমারে গড়া।
১৯৫৫ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঢাকা স্টেডিয়ামে মোট ৪টি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ব ক্রিকেটের বেশ কয়েজন কিংবদন্তি এই ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলে গেছেন। সেই তালিকায় সবার আগে চলে আসবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তথা সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্সের নাম।
পাকিস্তান আমলে ঢাকার দর্শকরা এই মাঠে বসে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সবসময়ের অন্যতম সেরা ওপেনার কনরান্ড হান্ট, অস্ট্রেলিয়ার দুই কিংবদন্তি নেইল হার্ভে, রিচি বেনো এবং নিউজিল্যান্ডের গ্লেন টার্নারের খেলা দেখেছেন।
অনেক ভিনদেশি তারকার পাশাপাশি ৭০ দশকে পাকিস্তানের হয়ে মাঠ মাতানো ইন্তিখাব আলম, আসিফ ইকবাল, মুশতাক মোহাম্মদ, জহির আব্বাসও ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলে গেছেন।
অভিষেক টেস্ট ম্যাচ দিয়ে হলেও ১৯৫৪ সালে নির্মিত ঢাকা স্টেডিয়াম পরবর্তীতে ফুটবলের অন্যতম তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। ১৯৫৫ সাল থেকেই ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল আর ক্রিকেট পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়।
তা অব্যাহত ছিল অনেকদিন। এরপর স্বাধীনতার পর এই মাঠে ফুটবল আর ক্রিকেট পাশাপাশি হয়েছে। তবে ১৯৮৭ সালে মিরপুরে শেরে বাংলা স্টেডিয়াম নির্মাণের পর ফুটবল পায় নতুন ভেন্যু। ১৯৮৮ সাল থেকে মিরপুরেও নিয়মিত ফুটবলের আসর বসেছে। কিন্তু তারপরও ফুটবল আর ক্রিকেটের সহঅবস্থান ছিল।
তখন ক্রিকেটকে ধরা হতো শীতকালীন খেলা। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি; এই ৩-৪ মাসই ছিল ক্রিকেট চর্চার সময়। বাকি মাসগুলোয় ফুটবল হতো। বছরের প্রথম কয়েক মাস ঢাকার ক্রিকেট লিগ আর মার্চ থেকে ফুটবল লিগ ও অন্যান্য টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতো।
ঢাকা লিগের পাশাপাশি ১৯৮০ সাল থেকে ঢাকার ফুটবলে শুরু হয় নতুন টুর্নামেন্ট ফেডারেশন কাপ। প্রতি বছর লিগ শুরুর আগে মাঠে গড়াতো ফেডারেশন কাপ। তারপর ডামফা কাপও আয়োজিত হয়। এরও আগে স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে আবার মাঠে গড়ায় আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবল।
শুধু ফুটবল আর ক্রিকেট নয়। ঢাকা স্টেডিয়ামে হকি, কুস্তির আন্তর্জাতিক আসরও বসেছে। ১৯৮৫ সালে এশিয়ার হকির বৃহত্তম আসর এশিয়া কাপের মূল পর্ব হয় ঢাকায়; ঢাকা ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে।
তখন বিশ্ব হকিতে ভারত আর পাকিস্তান অন্যতম পরাশক্তি। হোক তা মহাদেশীয় আসর কিংবা বিশ্ব হকির সর্বোচ্চ আসর; সব জায়গায় পাকিস্তান ও ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল ৭০ ও ৮০ দশকে। ঘাসের মাঠে হকির বিশ্বসেরা তারকাদের নৈপুণ্য চোখের সামনে দেখার সুযোগ হয় বাংলাদেশের হকি অনুরাগীদের।
বলে রাখা ভালো, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের যে দলটি ঢাকায় এশিয়া কাপ খেলতে এসেছিল, সেটা ছিল বিশ্বসেরা দল। ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক স্বর্ণ বিজয়ী দল ছিল পাকিস্তান। সেই স্কোয়াডের প্রায় ৮-১০ ছিলেন পাকিস্তানের ৮৫’র এশিয়ান কাপ দলে। কে ছিলেন না? তখনকার বিশ্ব হকির সেরা সেন্টার হাফ হানিফ খান পাকিস্তান দলের মূল প্লে মেকার। ওয়ার্ল্ড হকির এক নম্বর ফরোয়ার্ড হাসান সর্দার, দুই তুখোড় উইঙ্গার কালিমউল্লাহ, সামিউল্লাহ, সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার কাশিম জিয়া ওই সময়ে বিশ্ব হকির অন্যতম সেরা তারকা।
ভারতের দলটিও কম শক্তিশালী ছিল না। রক্ষণ দুর্গে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার পারগাত সিং, মাঝ মাঠে সোমায়া, প্লে মেকার ও স্টিক ওয়ার্কের অনুপম প্রদর্শনীতে লাখ ভক্তের মন জয় করা মোহাম্মদ শহীদ আর দারুণ স্কোরার মোহাম্মদ নাইমের গড়া ভারতের ফ্রন্টলাইন দুর্দান্ত ছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে হওয়া ফাইনালে ভারতকে ৩-২ গোলে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতে নিয়েছিল পাকিস্তান।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও ঘটনাবহুল সে এশিয়া কাপের ফাইনালে অন্তত ৫ থেকে ৭ হাজার দর্শক মাঠে বসে খেলা দেখেন। গ্যালারি উপচে পড়ায় দর্শকদের সাইডলাইনের ধারে বসার সুযোগ দেওয়া হয়।
এর আগে ৭০ দশকে (১৯৭৭) ভারতের অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন আর ইরানের সফেদরুদ ক্লাবের আগা খান ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালেও মাঠের ঠিক ধারে বসে খেলা দেখেছিলেন বেশ কয়েক হাজার ফুটবল অনুরাগী। সে ম্যাচে গুরুদেব সিংহের অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের বিপক্ষে ইরানের সফেদরুদ ক্লাব জিতেছিল ৩-০ গোলে।
তার আগে ১৯৭৬ সালে স্বাধীনতার পর হওয়া প্রথম আগা খান গোল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় মালয়েশিয়ার পেনাং এফ এ। সেই দলের দুই ভাই আলী বাকের ও ইসা বাকেরের খেলা দর্শকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়ায়। ষাটোর্ধ্ব ফুটবল অনুরাগীরা এখনো আলী বাকের ও ইসা বাকেরের ফুটবল নৈপুণ্যের কথা স্মরন করেন।
একই ভাবে ইরানের সফেদ রুদ ক্লাবের রাসুল হাগদুস্তের লম্বা থ্রোর কথাও এখনো মনে করেন কেউ কেউ। এর পর আরও দুটি আসর বসে আগা খান গোল্ডকাপের। ১৯৭৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় ইন্দোনেশিয়ার নিয়াক মিত্রা। আর ১৯৮১ সালে ঢাকার গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ব্যাংক ক্লাব যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হয় আগা খান গোল্ড কাপে।
স্বাধীনতার পর দেশের মাটিতে ক্লাব পর্যায়ের ফুটবলে ব্রাদার্স ইউনিয়নের ওই সাফল্যটাই বাংলাদেশের কোনো ক্লাবের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জেতার কৃতিত্ব। এরপর ঢাকা মোহামেডানও একবার ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগানকে পেছনে ফেলে মা মনি গোল্ডকাপ জয়ের কৃতিত্ব দেখায়।
এছাড়া সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উৎসাহে ১৯৮১ সালে ঢাকায় বসে প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ। প্রথমবার রানার্সআপ হলেও ১৯৮৯ সালে ষষ্ঠ আসরে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ লাল। দেশের ফুটবলের স্বর্ণ সময়ের দুই সেরা স্টপার কায়সার-মুন্না, অন্যতম সেরা প্লে মেকার সাব্বির, রুমি ও আসলামে গড়া বাংলাদেশ লাল দল কোরিয়ার এক প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে।
ভাবছেন ওই লাল দলের সাফল্যই বুঝি শেষ? না, তা নয়। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলেরও দুটি অনেক বড় সাফল্য, বিশাল অর্জন আছে ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে।
যার প্রথমটি ২০০৩ সালে সাফ ফুটবলে। মালদ্বীপকে হারিয়ে প্রথমবার দক্ষিণ এশীয় ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব দেখায় বাংলাদেশ। যদিও তারও ঠিক ১৮ বছর আগে ১৯৮৫ সালে এই ঢাকা স্টেডিয়ামেই প্রথম দক্ষিণ এশীয় ফুটবলের শিরোপা জয়ের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে ১২০ মিনিট সমাতালে লড়ে ১-১ গোলে ড্র রাখার পর টাইব্রেকারে গিয়ে হেরে যায় লাল-সবুজের দল। এরপর ২০১০ সালে ঢাকায় বসা শেষ এস এ গেমসে ফুটবলে স্বর্ণ পায় বাংলাদেশ। আফগানিস্তানকে হারিয়ে সোনালি সাফল্য তুলে নেয় টিম বাংলাদেশ।
৮৫’র এশিয়া কাপ হকির সফল সমাপ্তির ঠিক ৩ বছরের মাথায় ১৯৮৮ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে বসে এশিয়া কাপ ক্রিকেটের আসর। পাশাপাশি চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামেও কয়েকটি খেলা হয়। তবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান লড়াই এবং শ্রীলঙ্কা-ভারত ফাইনালসহ বিগ ম্যাচগুলো ঢাকা স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর ঢাকা তথা বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগীরা প্রথমবার একসঙ্গে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নামি ক্রিকেটারদের নৈপুণ্য চোখের সামনে দেখার সুযোগ পান।
ওয়াসিম আকরাম, এজাজ আহমেদ, সেলিম মালিক, শোয়েব মোহাম্মদ ও আব্দুল কাদিরের পাকিস্তান ওই এশিয়া কাপে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ভারত ও শ্রীলঙ্কা দুই দলের কাছেই হেরে ফাইনালে ওঠা হয়নি পাকিস্তানের।
পাকিস্তানকে টপকে ফাইনাল খেলার কৃতিত্ব দেখায় অর্জুনা রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। দুলিপ মেন্ডিস, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, রোশান মহানামা, অতুলা সামারাসেকেরা, অরবিন্দ ডি সিলভা, ব্রেন্ডন কুরুপ্পু, রবি রত্নানায়েকে, ল্যাব্রয়ের মত এক ঝাঁক প্রতিভাবান ক্রিকেটারে গড়া শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি ভারতের সাথে। দিলীপ ভেঙ্গসরকারের নেতৃত্বে কাপ জিতে নেয় ভারত। কৃষ্ণ মাচারি শ্রীকান্ত, নভোজাত সিং সিধু, মহিন্দার অমরনাথ, মোহাম্মদ আজহার উদ্দিন, কপিল দেব, আরশাদ আইয়ুব আর মানিন্দার সিংহের মত এক ঝাঁক তুখোড় ক্রিকেটারে সাজানো ভারত যোগ্যতম দল হিসেবে এশিয়া কাপের শিরোপা বিজয়ী হয়।
ঢাকা স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপ ক্রিকেট ও এশিয়া কাপ হকির আগেই বসেছিল মহাদেশীয় ফুটবলের এক বড়সড় আসর; এশিয়ান যুব (অনূর্ধ্ব-১৯) কাপ। সেটা ১৯৭৮ সালে। মহাদেশীয় ফুটবলে যুবাদের সে আসরটি অনূর্ধ্ব-১৯ ভিত্তিক হলেও ঢাকা তথা বাংলাদেশে খুব সাড়া ফেলেছিল। ফেলার কারণও ছিল। ১৯৭৮ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে হওয়া এশীয় যুব ফুটবলের সেটা ছিল ২০তম আসর। অংশ নিয়েছিল এশিয়ার ২২ দেশের যুবা ফুটবলাররা। স্বাধীনতার পর ঢাকায় সেটাই ছিল ফুটবলের মহাদেশীয় পর্যায়ে সবচেয়ে বড় আসর।
ওই আসরকে সামনে রেখে ঢাকা স্টেডিয়ামের ব্যাপক পরিচর্যা ও সংস্কার করা হয়। স্টেডিয়ামের পূর্ব দিকের গ্যালারি দোতলা করা হয়। ২০তম এশীয় যুব ফুটবলকে সামনে রেখে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম ফ্লাডলাইটও নির্মাণ করা হয়।
এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ ফুটবলারে সাজানো বাংলাদেশ যুব দল ওই আসরে দারুণ ফুটবল উপহার দিয়ে সবার নজর কাড়ে। অকুণ্ঠ প্রশংসাও পায়।
সুহাষ বড়ুয়া আর মইন গোলপোস্ট আগলেছেন। রক্ষণ দুর্গ সামলেছেন টুটুল, মুকুল, স্বপন দাস ও শেখ মোহাম্মদ আসলাম। পরবর্তীতে দেশের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বনে যাওয়া শেখ মোহাম্মদ আসলামকে ওই যুব ফুটবলে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে খেলান জার্মান কোচ ওয়ার্নার বেকেলহপ্ট।
মাঝমাঠে আশিষ, বাবলু আর মহসিনের সৃষ্টি ও সৃজনশীল ফুটবল সবাইকে মুগ্ধ করে। সামগ্রিকভাবে খুব গোছানো ফুটবল উপহার দেয় বাংলাদেশ। বলের আদান প্রদান, পাসিং ও গোলের উৎস রচনায় টিম বাংলাদেশ বেশ দক্ষতার পরিচয় দিলেও গোল করার দক্ষতা কম থাকায় দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
তারপরও ‘সি’ গ্রুপে ৫ দলের মধ্যে তৃতীয় স্থান পায় বাংলাদেশ। ৪ খেলায় ১ জয়, ২ ড্র আর এক পরাজয়ে আসর শেষ করে বেকেলহপ্টের শিষ্যরা।
সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ২-২ আর বাহরাইনের সাথে ১-১ গোলে ড্র করা বাংলাদেশ ১-০ গোলে হারায় আজকের মধ্য এশিয়ার প্রতিষ্ঠিত শক্তি ইরানকে। আর ২-০ গোলে হারে কুয়েতের যুব দলের কাছে। আর একটি ম্যাচ জিততে পারলেই ‘সি’ গ্রুপ থেকে পরবর্তীতে রাউন্ডে পা রাখতে পারতো বাংলাদেশ যুব দল।
এরপর ৮০’র দশকের শেষ দিকে ঢাকা স্টেডিয়ামে বসে আন্তর্জাতিক কুস্তির আসর। পাকিস্তানের বিশ্ব বিখ্যাত কুস্তিগীর ‘ভুলু’র ছেলে নাসির ভুলুর কুস্তির ‘দাও প্যাচ’ আর ‘ফ্লাইং কিক’ সবার মন কেড়ে নেয়। ঢাকা স্টেডিয়ামে বসে সে কুস্তি দারুণ উপভোগ করেন বাংলাদেশের দর্শকরা। সাথে বাংলাদেশের তখনকার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগীর আব্দুল জলিল ওই আসরে অংশ নিয়ে ভারত ও নিউজিল্যান্ডের বক্সারদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেন। তার নামকরণ হয় ‘টাইগার জলিল।’ সব মিলে দারুণ সাড়া জাগায় সে কুস্তির আসর।
এখানেই শেষ নয়। ঢাকা স্টেডিয়ামের রয়েছে আরও গৌরবউজ্জ্বল সাফল্য, সোনালী অতীত। বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেক এই মাঠে। ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে সে অভিষেক টেস্টে শতরান করে রেকর্ড বইয়ে নিজের নাম লেখান তখনকার বাংলাদেশ মিডল অর্ডার আজকের বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। এছাড়া অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়ও টেস্ট অভিষেকে এক ইনিংসে ৬ উইকেট শিকার করে রেকর্ড গড়েন।
এর বাইরে ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে প্রথম জয়টিও ঢাকা স্টেডিয়ামে, সেটা ২০০৪ সালে। আফতাবের স্মরণীয় ব্যাটিং ( ৯৮ বলে ৬৭) আর মাশরাফি বিন মর্তুজার মনে রাখার মত অলরাউন্ডিং পারফম্যান্সে (৩৯ বলে অপরাজিত ৩১ আর ২/৩৬ ও ২টি ক্যাচ) বাংলাদেশ পায় ১৫ রানের ঐতিহাসিক জয়।
সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে বীরেন্দর শেবাগ, যুবরাজ সিং, জহির খান, অজিত আগারকারের সাথে ছিলেন ভারতের সবসময়ের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ‘মিস্টার ‘কুল’ মহেন্দ্র সিং ধোনিও।
এর বাইরেও আছে। ঢাকাই ফুটবলে বিভিন্ন সময় ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে খেলে গেছেন ক্রিকেটের অনেক বিশ্ব তারকা। সে সব নাম লিখে শেষ করা যাবে না। ওয়াসিম আকরাম, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনাথ জয়সুরিয়া, নেইল ফেয়ারব্রাদার, অতুলা সামারা সেকেরা, ইজাজ আহমেদ, সেলিম মালিক, আব্দুর রাজ্জাক, শোয়েব মালিক, শহীদ আফ্রিদি, অজয় জাদেজা, চেতন শর্মা, সঞ্জিব শর্মা, স্টিভ টিকোলো, মরিস উদুম্বে, হিথ স্ট্রিক, ফিলিপ ডিফ্রেইটার্সসহ কত কত নাম! ফুটবলেও বিশ্বকাপ খেলা ঝুকভ, রহিমভ, সামির শাকির ও নাসের হেজাজির দৃপ্ত পদচারণা ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে।
কিন্তু সময়ের ফেরে সেই আলো ঝলমলে ঢাকা স্টেডিয়ামে নেমে এসেছিল অন্ধকার। যে মাঠ দীর্ঘ দিন ছিল রাজধানী ঢাকাবাসীর কলতানে মুখর, যে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে ছুটে যেতেন নানা বয়সী ক্রীড়া অনুরাগী; সেই মাঠ ভুগেছে দর্শক খরায়।
তার চেয়ে বড় কথা, নানা কারণে গত ৫৫ মাস ঐতিহ্যবাহী এই স্টেডিয়ামে খেলাই হয়নি। দীর্ঘদিন পর আবার ফুটবল ফিরছে ঢাকা স্টেডিয়ামে। আবার জ্বলে উঠেছে ঢাকা স্টেডিয়ামের নতুন ফ্লাডলাইট। সঙ্গে এ ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মত ছাদ পরিবেষ্টিত স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাচ্ছেন দর্শকরা।
পুরোনো ও মূল ভেন্যুতে গিয়ে ফুটবল ফিরে পাক হারানো গৌরব। নতুন ফ্লাডলাইটের মত হামজা চৌধুরীরাও জ্বলে উঠে আলো ছড়ান। দেশের ফুটবল ফিরে পাক হারানো ঐতিহ্য। ঢাকা স্টেডিয়ামও সোনালি দিন ফিরে যাক। সেটাই এখন প্রত্যাশা ক্রীড়ানুরাগীদের।
এআরবি/এমএমআর/জিকেএস