আইন-আদালত

হাসিনা গোটা দেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিলেন

হাসিনা গোটা দেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিলেন

ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বাসনায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে। এছাড়া গণভবন থেকে সারাদেশে ছিল অপরাধ সংঘটনের স্থান।

Advertisement

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলে প্রসিকিউশন টিম থেকে রোববার (১ জুন) ট্রাইবুন্যালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা গণহত্যা মামলার সূচনা বক্তব্য এমন তথ্য তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।

জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫টি অপরাধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছেন প্রসিকিউশন টিম।

রোববার (১ জুন) আদালতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আসামি শেখ হাসিনা গং’ মামলায় সূচনা বক্তব্য দেন।

Advertisement

বিচারকদের উদ্দেশ্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আজ ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে এই ট্রাইব্যুনালের এই পবিত্র কক্ষে দাঁড়িয়ে, আমি শুধু একজন আইনজীবীই নই, ইতিহাসের এক তাজা রক্তাক্ত অধ্যায়ের সশ্রদ্ধ ভাষ্যকার। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বাসনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে। অর্থাৎ শেখ হাসিনার অপরাধের স্থল ছিল গণভবন থেকে সারাদেশ।

তিনি বলেন, আমরা এই বিচার শুরু করেছি জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে। যেখানে নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র-যুবা, নারী ও শিশু- যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটাপদ্ধতি নামক কু-প্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস ও ন্যায়সংগত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।

২৪ এর এই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এই মামলার অভিযুক্ত আসামিদের কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হন। আসামিদের নির্দেশে ও তাদের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গ সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেফতার, নির্যাতন, গুম, চিকিৎসা প্রদানে বাধা এবং মৃত ও জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো।

আদালতকে তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আসামিদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বৈধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেওয়া তরুণদের অবিস্মরণীয় জাগরণ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আসামিরা সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ওইসব মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে নির্মূল বা স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক এবং পদ্ধতিগত আক্রমণ চালায়।

Advertisement

বিচারকদের উদ্দেশ্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয় বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, রোম স্ট্যাটিউট অফ দি আইসিসি এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য।

তাজুল ইসলাম বলেন, এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা। আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে - সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।

তিনি বলেন. এই আদালত এমন একটি সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে যা ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হয়ে থাকবে। আমরা চাই এ বিচার হোক নিরপেক্ষ, প্রমাণনির্ভর এবং ন্যায়ভিত্তিক। আমরা চাই এ বিচার শুধু বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে সৃষ্ট গভীর ক্ষত মুছে না দিক, বরং এটি হোক এক আত্মাভিমানী জাতির ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে এই মামলায় শ্যান অ্যারেস্ট দেখাতে বলেছেন আদালত। এই মামলায় পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এর মধ্যে গ্রেফতার রয়েছেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক আছেন। আগামী ১৬ জুন এই মামলার তিন আসামিকে হাজির করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে রোববার (১ জুন) ট্রাইব্যুনাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর আব্দুস সোবহান তরফদার ও প্রসিকিটর মো. মিজানুল ইসলাম। এসময় উপস্থিত ছিলেন গাজী এমএইচ তামিম, আব্দুস সাত্তার পালোয়ান, প্রসিকিউটর ওমর ফারুক প্রমুখ।

এফএইচ/এমআইএইচএস/জিকেএস