দেশজুড়ে

সম্পত্তি দখলে জীবিত ভাইকে জুলাই আন্দোলনে শহীদ দেখিয়ে মামলা

সম্পত্তি দখলে জীবিত ভাইকে জুলাই আন্দোলনে শহীদ দেখিয়ে মামলা

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কুশমাইল ইউনিয়নের ধামর গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের ছোট ছেলে মো. সেলিম (৪৮)। জীবিত মো. সেলিমকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ‘শহীদ’ দেখিয়ে মামলা করেছেন তারই বড় ভাই মোস্তফা কামাল (৫২)। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা করা ওই মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০-২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

Advertisement

সম্প্রতি এ ঘটনা জানাজানি হলে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। কারণ মো. সেলিম জীবিত আছেন। দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

গত বছরের ২৭ আগস্ট সেলিমকে নিজের ভাই উল্লেখ করে রাজধানীর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন মোস্তফা কামাল। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, ৩ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার শনির আখড়ার কাজলা পেট্রোল পাম্পের সামনে ছাত্র-জনতার মিছিলে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেলিম মারা যান। তার মরদেহ উদ্ধার করে রাজধানীর গোপীবাগ এলাকার রামকৃষ্ণ মিশনের (আর কে মিশন রোড) পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়। মামলার বাদী মোস্তফা কামালের ঠিকানা হিসেবে আর কে মিশন রোড, বদী মেম্বারের বাড়ি, মুগদা, ঢাকা উল্লেখ করা হয়।

একই বছরের ৩০ আগস্ট আদালতের আদেশে যাত্রাবাড়ী থানায় সেলিম হত্যা মামলা রেকর্ড হয়। জাতীয় পরিচয়পত্রে সেলিমের নাম মো. সেলিম থাকলেও মামলায় তাকে দুলাল হোসেন ওরফে সেলিম দেখানো হয়েছে।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেলিমের বড় তিন ভাইয়ের নাম হেলাল উদ্দিন, আবুল হোসেন ও মামলার বাদী মোস্তফা কামাল। প্রায় ২০ বছর আগে তাদের বাবা আব্দুল হাকিমের মৃত্যুর পর থেকেই ভাইদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। ভাইদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ২০২২ সালের ১৮ মে সেলিমকে গুরুতর জখম করা হয়। ওই ঘটনায় ২৪ মে সেলিম থানায় মামলা করেন। সেলিমের শুধু দুই কন্যা সন্তান থাকায় তার ভাগের সম্পত্তিতে নজর পড়ে বাকি তিন ভাইয়ের। মোস্তফা কামাল পূর্বপরিকল্পিতভাবে সেলিমকে নিয়ে মিথ্যা মামলা করেন। ‘মৃত’ দেখিয়ে বড় ভাই মামলা করায় সেলিম এখন নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে থানা ও আদালতে দৌড়াচ্ছেন।

স্থানীয়রা জানান, মোস্তফাকে এলাকার মানুষ মস্তু ডাকাত হিসেবে চেনেন। ধামর গ্রামের গোলাপ মিয়া, নীল মামুদ ও রয়েল নামের ১০ বছর বয়সী শিশু হত্যায় তিনি জড়িত। এমন কোনো অপরাধ নেই, তিনি করতেন না। তার ভয়ে এলাকার মানুষ এখনো আতঙ্কিত। ২০০৫ ও ২০১২ সালে মোস্তফার বিরুদ্ধে থানায় দুটি হত্যা মামলা হয়। সর্বশেষ রয়েল হত্যার পর মোস্তফা এলাকা ছাড়েন।

কথা হয় মো. সেলিমের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ভাইদের অত্যাচারে এক বছর আগে বাড়ি ছেড়ে ধামর বেলতলী বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে ঘর করেছি। বর্তমানে সেখানেই বসবাস করে একটি দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করছি।

তিনি বলেন, আমার ভাইয়েরা প্রায় ১৫০ শতক জমি দখল করে রেখেছেন। জমি নিয়েই ভাইদের সঙ্গে বিরোধ। এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে। একটি ইস্যু সৃষ্টি করে আমাকে পরিকল্পনা করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমার সম্পত্তি গ্রাস করতে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই তিন ভাই এই নাটক সাজিয়েছে।

Advertisement

সেলিম আরও বলেন, আমি জীবিত সেটি প্রমাণ করতে দুইবার আদালতসহ কয়েকবার পুলিশের কাছে গিয়েছি। আমি আমার ভাইদের বিচার চাই।

সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন বলেন, আমার স্বামীকে হত্যা করতে আগেই মৃত বানানো হয়েছে। নিশ্চয় আমার স্বামীকে সুযোগমতো হত্যার চেষ্টা করা হবে। আমরা ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছি।

সেলিমের ভাই হেলাল উদ্দিনের মেয়ে ঝুমি আক্তার বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে মস্তু কাকা বাড়িতে আসেন না। তিনি ঢাকায় বসবাস করেন। আমার বাবাকে কেন সাক্ষী করা হয়েছে তা আমাদের জানা নেই।

স্থানীয় মোর্শেদ আলী বলেন, মস্তু এলাকায় একজন চিহ্নিত ডাকাত। তিনি বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তার জন্য এখনো এলাকার মানুষ আতঙ্কে থাকেন। তাকে গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তি দিলে এলাকার মানুষ আতঙ্কমুক্ত হবে।

বক্তব্য জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগের উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম বলেন, মামলার বাদী মস্তুর বিরুদ্ধে অন্য মামলা থাকায় তিনি পলাতক। সেলিম মৃত নন, এটা নিশ্চিত করতে আদালতের মাধ্যমে দুই ভাইকে সামনাসামনি করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আবেদন করা হয়েছে। আদালত অনুমতি দিলে সিআইডি ডিএনএ পরীক্ষা করবে।

এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান বলেন, পারিবারিক বিরোধের কারণেই জীবিত সেলিমকে মৃত দেখিয়ে তার ভাই মামলা করেছেন। মস্তুর নামে দুটি হত্যা, একটি চাঁদাবাজি এবং একটি মারামারির মামলা রয়েছে। জুলাই আন্দোলনে মৃত দেখানোর পর সেলিম আতঙ্কে থাকায় তাকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

কামরুজ্জামান মিন্টু/এফএ/এমএস