অর্থনীতি

ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ থাকা জরুরি

ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ থাকা জরুরি

বাজেট হওয়া উচিত বাস্তবতার নিরীক্ষণে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ দেখানো হবে। যেখানে একটি শক্তিশালী অর্থনীতিক দিকনির্দেশনা থাকবে, যা পরবর্তী নির্বাচিত সরকার অনুসরণ করতে পারে।

Advertisement

আসন্ন জাতীয় বাজেট নিয়ে জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি ইব্রাহীম হুসাইন অভি।

জাগো নিউজ: জুন মাসের ২ তারিখ সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করবে। এবারের বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

আমীর খসরু: বাজেট হচ্ছে একটি স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ব্যাপার। এখানে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি নানান ধরেনের পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ থাকে। আরও থাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দর্শন ও দেশের উন্নয়ন ভাবনা। যেহেতু এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকার, তাই তাদের উচিত হবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা মিলিয়ে একটি বাস্তবসম্মত বাজেট প্রণয়ন করা। এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ড্যামেজ কন্ট্রোল—অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ করা।

Advertisement

হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ববর্তী বাজেটের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। আগের বাজেটের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা মোটেও ভালো হবে না বা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ আমরা জানি, পূর্ববর্তী বাজেট কী উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল, কী ধরনের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, কারা উপকৃত হয়েছিল এবং সেখানে কী পরিমাণ দুর্নীতি ছিল সেটা অন্তর্নিহিত আছে।

সুতরাং, ড্যামেজ কন্ট্রোল- অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ করার প্রতি গুরুত্ব দিলে ভালো হবে। এতে একটা ক্ষেত্র তৈরি হতো যাতে নতুন সরকার এসে পরিপূর্ণভাবে তাদের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা অনুযায়ী শুরু করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার একটি ফাউন্ডেশন তথা রূপরেখা দিতে পারে, যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের পরিকল্পনা করার সুযোগ থাকে। জাগো নিউজ: তাহলে আপনার মতে নতুন বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

আমীর খসরু: বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করে একটি নতুন ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে, যাতে নির্বাচিত সরকার এসে সেখান থেকে কার্যক্রম শুরু করতে পারে। এটা তাদের জন্যও সুবিধাজনক হবে।

বাজেট হওয়া উচিত বাস্তবতার নিরীক্ষণে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের পথ দেখানো হবে। এই অন্তর্বর্তী সরকার একটি ভিত্তি স্থাপন করতে পারে, যা পরবর্তী সরকার অনুসরণ করতে পারবে।

Advertisement

আরও পড়ুনএলএনজি আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি, সম্ভাব্য করহার চালু থাকছেদ্বিগুণ হচ্ছে ভ্যাট, প্লাস্টিক পণ্য-এসি-ফ্রিজের দাম বাড়তে পারেবাস্তবভিত্তিক-জীবনঘনিষ্ঠ বাজেট চান সাধারণ মানুষমার্কিন শুল্ক-ভারতের নিষেধাজ্ঞায় চাপে পড়বে দেশের রপ্তানি খাত 

জাগো নিউজ: বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

আমীর খসরু: এখনই বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কেউই বড় সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী না। বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে। সেটা সেবাখাত হোক কিংবা উৎপাদনমুখী শিল্প। এই মুহূর্তে বিনিয়োগ আশা করার খুব বেশি সুযোগ নেই। নতুন নির্বাচিত সরকার এলে তখন হয়তো স্থগিত রাখা প্রকল্পগুলো আবার চালু হবে। তখন বিনিয়োগ আসবে। এখন একটা প্রশ্ন সবার মনে, নির্বাচন কবে হবে? তারা দেখতে চাচ্ছে আগামী নির্বাচিত সরকারের বিনিয়োগ পলিসি কী ধরনের হবে? তার ওপর ভিত্তি করে তারা বিনিয়োগ করবে।

জাগো নিউজ: বর্তমানে রাজস্ব আহরণ একটা খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে রাজস্ব বাড়ানোর উপায় কী হতে পারে?

আমীর খসরু: রাজস্ব তো ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে আসে। রাজস্ব কোথা থেকে আসবে? বর্তমানে ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিম্নমুখী। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে গেছে। এ অবস্থায় রাজস্ব সংগ্রহ করাই তো কঠিন, বৃদ্ধি তো পরের কথা।

ব্যবসায়ীদের কনফিডেন্স ফিরিয়ে আনতে হবে। বিনিয়োগ না করে যদি বলেন ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বাড়াতে হবে, তাহলে সেটা হবে না। সম্পদ সৃষ্টি হলে সম্পদ থেকে আয় করতে পারবেন। এই মুহূর্তে সম্পদ সৃষ্টির সুযোগ কম। সম্পদ সৃষ্টি না হলে আয় করার সুযোগ থাকে না। এই মুহূর্তে সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে না, তাই রাজস্ব আহরণও কঠিন।

রাজস্ব বাড়াতে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক অবস্থায় না ফেরা পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ বাড়বে না। এই মুহূর্তে ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।

জাগো নিউজ: এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?

আমীর খসরু: আপনি একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার কথা বলছেন, কিন্তু আমি অর্থনীতির মুক্তির কথা বলছি। আমি মনে করি এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। দেশের অর্থনীতি যখন নিম্নমুখী, নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে—তখন আপনি কীভাবে উন্নয়নের কথা বলেন?

আমার স্পষ্ট মত হলো—এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আমরা যোগ্যতা অর্জন করেছি, শুধু উন্নয়নের গল্প শোনানোর জন্য শেখ হাসিনা এটা করেছিলেন। আমি বলবো, এখন আমাদের দরকার গ্র্যাজুয়েশন নয়, সালভেশন।

বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের একটি স্বস্তির জায়গা প্রয়োজন। আমি মনে করি এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন অন্তত চার বছর পিছিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রস্তাব দেওয়া উচিত। এই সময়ে শ্রম অধিকার, বাজার প্রবেশাধিকার, ট্যারিফ সুবিধা হারানোর বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।

গ্র্যাজুয়েশন মানুষ করে ওপরের দিকে যাওয়ার জন্য, কিন্তু আমাদের অর্থনীতি তো নিম্নমুখী। বর্তমানে যেখানে আছে সেখান থেকে আগে উদ্ধার করতে হবে, পরে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে ভাবতে হবে।

জাগো নিউজ: ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

আমীর খসরু: তারা ব্যাংকখাত ও শেয়ারবাজারকে ফাঁকা করে দিয়েছে। ব্যাংকখাত ও পুঁজিবাজার এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখান থেকে আর নিচে নামার সুযোগ নেই। এসব খাত রক্ষা করতে হলে আমাদের নতুন ধরনের অর্থনৈতিক মডেল দরকার।

জাগো নিউজ: আপনি কী ধরনের অর্থনৈতিক মডেলের কথা বলছেন?

আমীর খসরু: বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। একটি অর্পিত চতুর্থাংশকে অযাচিত সুবিধা দেওয়ার জন্য এটি করা হয়েছে। লক্ষ্য ছিল অর্থ লুটপাট ও পাচারের পথ প্রশস্ত করা।

অর্থনীতির উদারীকরণ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রণমুক্তি অপরিহার্য। এটি আমাদের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান করেছিলেন। ফলস্বরূপ, দেশ শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হয়েছে। একটি বাস্তবভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির দিকে যেতে হবে, যেখানে সব শ্রেণির মানুষ বিনিয়োগ ও সম্পদ সৃষ্টির সুযোগ পাবে।

আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/কেএসআর