মোহাম্মদ রাজীব
Advertisement
বাড়িটির নাম ‘আনন্দধারা’। নামটি যতটা না শুনতে ভালো লাগে, তার চেয়েও বেশি আনন্দ উপভোগ করবেন যখন আপনি নিজ চোখে তা দেখবেন। দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যাবে আপনার হৃদয়-মন, আপনি যখন দেখবেন কোনো বাড়ির দেওয়াল সদা জাগ্রত বুক সেলফ। তখন আহ্লাদে পুলকিত হবে আপনার আত্মা।
বাড়িটির সীমানাপ্রাচীরে কালজয়ী লেখকদের ৩৩টি বইয়ের মোড়ক শোভা পাচ্ছে। সাজানো রয়েছে—মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’, সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’, সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিণী’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র মতো বহু পাঠকনন্দিত বই।
বলছি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কালেখাঁর ভান্ডা গ্রামের বইপ্রেমী রাকিব হাসান ভূঁইয়ার কথা। তিনি বাড়ির সীমানাপ্রাচীরে ইট-পাথরের বদলে সাজিয়েছেন বইয়ের মোড়কে। গেটের দু’পাশের সীমানাপ্রাচীর যেন বুক সেলফ। প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে অগণিত মানুষ ভিড় করেন বাড়িটি দেখতে।
Advertisement
জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শামছুল হক ভূঁইয়ার ছেলে রাকিব হাসান ভূঁইয়া। ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। একজন বইপ্রেমী হিসেবে পরিচিত। পরিবারের সবার বইয়ের প্রতি আছে আসক্তি। শৈশবে লাইব্রেরি ছিল বাড়িতে। সবাই আগ্রহ নিয়ে বই পড়তেন। বড় ভাই লেখক। বইপ্রেমী প্রয়াত বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর বইয়ের প্রতি উৎসাহ জোগাতে কালজয়ী কিছু বইয়ের মোড়কে বাড়ির প্রাচীর নান্দনিক করে সাজিয়েছেন। সরারচর রেল স্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জে যেতে দেখা মিলবে বাড়িটির।
বাড়িতে প্রবেশের প্রধান গেটটি দেখতে ঠিক বইয়ের মতো। চৌদ্দ ফুট উঁচু, নব্বই ফুট দীর্ঘ প্রাচীরজুড়ে বাংলা সাহিত্যের ৩৩টি কালজয়ী বই স্থান পেয়েছে। গ্রন্থপ্রাচীর দেখতে আসা হাজী অ্যাডভোকেট ওসমান গণি মডেল কলেজের প্রভাষক রাজ্জাকুন্নাহার সুমি বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম মোবাইল গেমস, ফেসবুক এবং ইউটিউবে আসক্ত। এই যখন পরিস্থিতি; তখন রাকিব হাসান দেখিয়েছেন বইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। মানুষকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করার যে প্রয়াস তা অতুলনীয়। এমন উদ্যোগে পাঠক কালজয়ী বই ও লেখক সম্পর্কে জানবে। বই মানুষকে আলোর পথ দেখায়, তা তারা বুঝতে পারবেন।’
আরও পড়ুন ভালোবেসে অবশেষে: প্রেমনির্ভর কাহিনি যে পাঁচটি বই একবার হলেও পড়া উচিতমাধ্যমিক পড়ুয়া উম্মে হাবীবা বলেন, ‘আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি বাড়িটি দেখার জন্য। এখানকার অনেকগুলো বই আমাদের ঘরে আছে। বাকি বইগুলোর নাম লিখে নিচ্ছি।’ রাকিব হাসান ভূঁইয়ার মা শতবর্ষী শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ির প্রাচীরের এই কাজ দেখতে অনেক লোক আসছে। বিষয়টি আমার কাছে ভালো লাগছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাড়িতে একটি লাইব্রেরি ছিল। ছেলেমেয়েদের বইপ্রীতি আমাকে আনন্দ দেয়।’
মো. রাকিব হাসান ভূঁইয়া জানান, বইয়ের আদলে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের ধারণাটি এসেছে ২০১৫ সালের জাতীয় বইমেলায় গিয়ে। সেখানে একটি প্রকাশনীর স্টল দেখেছিলেন তিনি। বুক সেলফের মতো সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে দক্ষ কারিগর পেতে ছয় মাস খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছে তাঁকে। কারিগরদের সাথে দিনরাত শ্রম দিয়ে কালজয়ী বইগুলোর মোড়কের আদলে প্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির কারণে বর্তমান প্রজন্ম বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। অথচ একজন মানুষের প্রকৃত বন্ধু বই। একজন বন্ধু ছেড়ে যেতে পারে কিন্তু বই সারাজীবন বাতিঘর হয়ে পথ দেখায়। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে বাড়িতে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার করবো।’
রেললাইনের পাশে বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় ট্রেনে যেতে যেতেও। অভিনব বাড়িটি দেখে রাকিবের সৃজনশীল চিন্তা ও রুচির প্রশংসা করছে সচেতন মহল। এ অভিনব উদ্যোগ বইয়ের প্রতি সব শ্রেণির মানুষকে আগ্রহী করে তুলবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএসএম