সফিকুল হাসান সোহেল
Advertisement
নিয়মিত ছোটকাগজ সারেঙ-এর একুশতম সংখ্যাটি এবার হেলাল হাফিজকে স্মরণ করে প্রকাশিত হয়েছে। যা এককথায় বলা চলে বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী দলিল। দেশের জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজকে অন্যরা ভুললেও এ কাগজ ভোলেনি। ছোটকাগজের উজ্জ্বলতম সংকলন সারেঙ। এ দেশে অসংখ্য সাহিত্য ম্যাগাজিন, ছোটকাগজ, পত্রপত্রিকা নিয়মিত কিংবা অনিয়মিতভাবে বের হচ্ছে। নানা বিষয় নিয়ে লেখা ছাপা হচ্ছে। অথচ ভাবতে কষ্ট হয়, বাংলা সাহিত্যের একজন সেরা কবিকে নিয়ে আলাদা ভাবে দূরের কথা তাকে নিয়ে দু’একটা প্রবন্ধও চোখে পড়েনি। বিষয়টি যেমন আক্ষেপের; তেমনি দৃষ্টিকটুও বলা চলে।
আমরা সবাই অতীত ভুলে যাই। বর্তমান নিয়ে পড়ে থাকি। তাই ভবিষ্যৎ অন্ধকার আমাদের। বার বার সেটাই মনে করিয়ে দেয়। তবুও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। নিভৃতচারী সমকালীন এই সেরা কবিকে স্মরণ করে সারেঙ সম্পাদক আবদুর রহমান মল্লিক সময়ের চাহিদা পূরণ করেছেন। তাকে নিয়ে একটা ঝকঝকে তথ্যসমৃদ্ধ সংখ্যা উপহার দেওয়ায় ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
সারেঙ-এর প্রতিটি সংখ্যা দেদীপ্যমান বিখ্যাত সাহিত্যিক-গবেষকদের মননশীলতায় সিক্ত। বিষয় ও ভাবের বৈচিত্র্যে নতুন ভাবনার আকর, যেন চিন্তার প্রসারের বাতিঘর। কবিতা, প্রেম, আলস্য, নিভৃতবাস এ সময়ের অপচয়—এসব নিয়েই কবি হেলাল হাফিজ। মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়ে হয়েছেন জীবন্ত কিংবদন্তি। যার কবিতা ছাড়া আজও অপূর্ণ থাকে এ দেশের মুক্তির আন্দোলন। আবার যার ইন্দ্রিয়ঘন রোমান্টিকতা ছাড়া পূর্ণ হয় না নারী-পুরুষের প্রেমের অভিজ্ঞান। যার দুঃখের সংস্পর্শ ছাড়া কবি হতে পারে না বর্তমানের কোন তরুণ। দুঃখকে অবলম্বন করে তুমুল সন্ন্যাসী যিনি; তিনি হেলাল হাফিজ।
Advertisement
এবার সারেঙ-এর সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা যাক। শুরুতেই রয়েছে হেলাল হাফিজকে নিয়ে আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ। সাদা-কালো প্রচ্ছদটি অন্য ধরনের কথা বলে। কবির জীবনের সঙ্গে যেন মানানসই। যা পুরো সংখ্যাটিকে অন্যরকম করে তুলেছে। তারপর রয়েছে নাতিদীর্ঘ একটা তথ্যসমৃদ্ধ সম্পাদকীয়। এ সংখ্যায় রয়েছে হেলাল হাফিজকে নিয়ে ১৭টি সুখপাঠ্য তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ।
আরও পড়ুন মৈমনসিংহ-গীতিকার সেমিনার ও লোকগানের আসর ওষুধহীন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের উপায় শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচনগদ্য বিভাগের শুরুতেই হেলাল হাফিজের নিজের লেখা একটি প্রবন্ধ সারেঙকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার স্বপ্নের স এর নিচে ব ফলা ছিল না। আত্মজৈবনিক প্রবন্ধটি পড়ে মনটা নাড়া দিতে বাধ্য। আজন্ম প্রেম-ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, সৈয়দ তোশারফ আলী, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, ড. তপন বাগচী, সৌমেন্দ্র গোস্বামী, জমির উদ্দিন মিলন, সিরাজুল ইসলাম আবেদ, গাজী গিয়াস উদ্দিন, শাহীন চৌধুরী, ইসমত শিল্পী, এমরান কবির, নূরননবী বাবুল, ওয়াহিদ জামান ও সফিকুল হাসান সোহেলসহ দেশবরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, গবেষকদের সমাহারে সারেঙ নবযৌবনে উদ্বেলিত। তাদের লেখনিতে দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ যেন জীবন্ত হয়ে আছেন। অসাধারণ হয়েও সাধারণে বসবাস করা মানুষটি সত্যিই সবার মাঝে বেঁচে আছেন। থাকবেন তিনি। থাকবেন সাহিত্যের পাতায়। জীবতকালে সবার মাঝে থেকেও তিনি হঠাৎ করে লুকিয়ে যেতেন, বছরের পর বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে পারতেন। তার মৃত্যু নেই—দেহান্তর হয়েছেন কেবল।
এবারের সংখ্যায় সেরা আকর্ষণ বলা চলে হেলাল হাফিজের সেরা সৃষ্টি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইয়ের সবগুলো কবিতা। যা অনেক কবিতাপ্রেমীর চাহিদা মিটিয়েছে। এরপর রয়েছে বিভিন্ন সময়ে তার দেওয়া ৫টি সাক্ষাৎকার। এবারে কবিতা লিখেছেন আরিফ চৌধুরী, ফরিদুজ্জামান, শওকত এয়াকুব, নাসরীন গীতি, সৌহার্দ সিরাজ, নেহাল হাফিজ, ইয়াসিন ঠাকুর ও হামিম হাফিজুল্লাহ শেফা। সবশেষ রয়েছে হেলাল হাফিজকে নিয়ে রুশ্নি আরার গবেষণা প্রবন্ধ ‘কবি হেলাল হাফিজ-এর কবিতায় সুরের ব্যবহার ও শিল্পরূপ বিচার’ যা চিন্তাকর্ষক। যা কবিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
তার ব্যক্তিগত জীবন বেশ সংগ্রামী। দীর্ঘদিন তিনি আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছেন। তা সত্ত্বেও কবিতা থেকে দূরে সরে যাননি। তিনি চেষ্টা করে গেছেন তার কবিতা দিয়ে মানুষকে সাহস জোগানোর। চেষ্টা করেছেন তার কবিতা দিয়ে এই সমাজ, এই দেশকে পরিবর্তন করতে। বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজ এমন একজন কবি, যিনি খুব কম লেখার মধ্য দিয়েই চিরস্থায়ী স্থান অর্জন করেছেন। তার সাহিত্য স্বল্পসংখ্যক হলেও তা যুগে যুগে পাঠকদের মনে দাগ কাটবে। প্রেম ও বিরহের এই স্বল্পপ্রজ আধুনিক কবি চিরকাল বেঁচে থাকবেন তার কবিতায়, পঙ্ক্তিতে এবং নানা বাণীতে। কবির কলম থেমে গেলেও হেলাল হাফিজ বাংলা কবিতায় প্রাসঙ্গিক থাকবেন আরও অনেক বছর, সে কথা সহজেই বলা চলে।
Advertisement
সারেঙ সাহিত্যজগতে এক ব্যতিক্রমী নাম। শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিয়মিত প্রকাশ এর চলার পথ রুদ্ধ করতে পারেনি। সারেঙ সত্যিকার অর্থেই সাহিত্যে সারেঙ হয়েছে। এ কাগজ ভবিষ্যতেও এরকম নতুন নতুন বিষয়ভাবনা নিয়ে প্রকাশিত হবে—এ আশা আমরা করতেই পারি। সবার ওপরে বলা চলে, যারাই দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজকে নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা করবেন; তারা অবশ্যই এবারের ১৭৬ পৃষ্ঠার সারেঙ-এর তথ্যকে রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগাতে পারবেন। এটি সারেঙ-এর বিরাট অর্জন বলে আমি মনে করি। সবশেষে আশা এটাই, সারেঙ-এর যাত্রা আরও মসৃণ হোক।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
এসইউ/জিকেএস