বিলকিস নাহার মিতু
Advertisement
আমরা যারা ভূগোলের শিক্ষার্থী; তাদের সাথে ভ্রমণের এক গভীর সম্পর্ক আছে। যদিও ভূগোলের ভাষায় আমরা একে ‘ফিল্ড ওয়ার্ক’ বলে সম্বোধন করি। কারণ আমাদের মাঠে কাজ করতে হয়। তবে ভ্রমণ নিয়েই ডুবে থাকি আমরা। প্রতি বছরের ন্যায় অনার্স ২য় বর্ষের আমরা ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। জায়গা নির্ধারণ করা হলো পঞ্চগড়। যার দূরত্ব খুলনা থেকে প্রায় ৫১১ কিলোমিটার। আমরা ৫৭ জন শিক্ষার্থী। পরিচালনায় ছিলেন গোপাল স্যার ও সুজয় স্যার। ৪ নভেম্বর রাত ৯টায় আমাদের ট্রেন ছিল। আমরা খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে মিলিত হলাম। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের একটি বগির কোনো সিটই পাওয়া গেলো না। স্যারদের সহায়তা এবং বন্ধুদের একতার বলে যেভাবে হোক সিট পেতে সমর্থ হলাম।
অবশেষে খুলনা থেকে প্রায় রাত ১১টায় আমাদের ট্রেন সীমান্ত এক্সপ্রেস ছাড়লো উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে। ‘ঙ’ বগিতে সিট পড়েছিল আমার সঙ্গে আরও ১৫ জনের। ট্রেনের জানালা দিয়ে রাতের দৃশ্য উপভোগ করছি। বন্ধুরা গল্প-গুজবে ব্যস্ত। কেউবা সাজুগুজু করা নিয়ে। তবে সব বন্ধু এক বগিতে পড়লে আরও মজা হতো। ট্রেন তার গতিতে চলছে। কারো কারো চোখে ঘুম লেগে আছে। কিন্তু সবাই যেন ঘুমকে প্রতিরোধ করতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে শোভন এলো গান করতে করতে। ওর গান শুনে ঘুমভাবটা একটু কাটলো।
রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পেলাম না। হঠাৎ হাততালির শব্দে ঘুম ভাঙলো। জীবনে মায়ের ডাকে, ফোনের অ্যালার্মে কিংবা মোরগ বা আজানের শব্দে ঘুম ভাঙলেও তৃতীয় লিঙ্গের ডাকে এই প্রথম ঘুম ভাঙার অভিজ্ঞতা হলো। তারা চলে যেতেই জানালা খুলে দিলে দেখি চারদিক ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। তখন প্রায় পার্বতীপুরের কাছাকাছি চলে এসেছি। গোপাল স্যার অন্য বগি থেকে সর্বাবস্থায় আমাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন।
Advertisement
সকাল ৯টায় ডোমারে নামি। সেখান থেকে রিজার্ভ করা বাসে সেন্ট্রাল গেস্ট হাউজের দিকে যাত্রা শুরু করি। ১১টার মধ্যে পঞ্চগড়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে যাই। যত দ্রুত সম্ভব হাত-মুখ ধুয়ে পাশেই নূরজাহান হোটেলে সকালের নাশতা খাওয়া হলো। এরপর গেস্ট হাউজের রিসিপশনে মিলিত হলাম। গোপাল স্যার এবং সুজয় স্যারের নির্দেশনায় ফিল্ড ওয়ার্কের কাজে নেমে পড়লাম। ফিল্ড ওয়ার্কের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মীরগড় পাথরশ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক জরিপ’। আমরা গ্রুপ ভিত্তিক কাজ করছিলাম। পাথরশ্রমিকদের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে অনেক কিছু জানলাম। সেখানে কীভাবে পাথর তোলা হয়। সে দৃশ্যও উপভোগ করছিলাম।
মীরগড়ে বিখ্যাত কাঠের সেতুটি দেখার সৌভাগ্য হলো। জরিপের কাজ করতে করতে প্রায় আসরের ওয়াক্ত শুরু হয়। এরমধ্যে স্যার সবাইকে দুপুরের খাবারের জন্য ডাকলেন। খাবার খেয়েই আমরা গেলাম পঞ্চগড় রক্স মিউজিয়াম দেখতে। প্রাচীনকালের ছোট-বড় পাথর সেখানে রয়েছে। এ ছাড়া আদিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিস এবং প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো নৌকাও এ মিউজিয়ামে দেখতে পেলাম। মিউজিয়াম দেখা শেষে গেস্ট হাউজের দিকে সন্ধ্যার পরে চলে আসি। রুমে ঢুকে টিভি দেখলাম। পাশের রুম থেকে স্নিগ্ধা, নাজিফা, বন্যা আরও অনেকে এলো; যাদের সাথে গল্প করলাম।
রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ ভোরে দ্রুত উঠতে হবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে হলে। সকাল সাড়ে ৫টার মধ্যে সবাই তৈরি হলো। কেউ কেউ সাজুগুজু করতে গিয়ে দেরীও করে ফেললো। বের হতে দেরী হওয়ায় সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিল, কাঞ্চনজঙ্ঘা আর দেখা হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে আমরা তেঁতুলিয়ায় পৌঁছে গেলাম। স্যারদের পিছু নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দেখলাম অসংখ্য পর্যটকের ভিড়। তারা বলছেন, ওই যে দেখা যাচ্ছে! আবছা আবছা দেখতে পেলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা। মহানন্দা নদীর তীরঘেঁষে কতো মানুষের আনাগানো দেখে ভালোই লাগলো। সেখান থেকে গ্রুপ গ্রুপ করে ভ্যানে উঠে সমতল ভূমির চা বাগান দেখতে গেলাম। যেতে যেতে বিভিন্ন স্পটে সবাই থামছেন আর ছবি তুলছেন।
আরও পড়ুন
Advertisement
চা বাগানের দিকে গিয়ে কাঁচা পাতার চা পান করলাম। খানিক বাদেই সেখানে চা কেনার ধুম পড়ে গেলো। সেখান থেকে ভারতের চা বাগানের দিকে গেলাম। চা বাগানে ঢুকে যে যার মতো নানা পোজে ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা তেঁতুলিয়া বাজারে পৌঁছলাম। সেখানে সকালের নাশতা ও চা খেলাম। সেই মস্ত তেঁতুলগাছটাকেও দেখলাম। সেখান থেকে মিনি মিনাবাজারের উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম। চলতি পথে বাস থামিয়ে স্যার আমাদের আবারও ছবি তোলার সময় দিলেন। চা বাগানের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে ঢুকে গেলাম। শরীরজুড়ে তখন চায়ের গন্ধই আসছিলো।
সেখান থেকে বাসে উঠে মিনাবাজার নেমে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট আনন্দধারা রিসোর্টের দিকে পা বাড়ালাম। যেতে যেতে কয়েকটা চা পাতাও ছিঁড়ে নিলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। রিসোর্টের চারপাশে জঙ্গল এবং কিছুটা অযত্নে আছে বলা চলে। তবে রিসোর্টের ডিজাইন আমার খুব ভালো লেগেছে। রিসোর্ট দেখার পর দুপুরের খাবার খেয়ে বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্টের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সেখানে পৌঁছে দুই দেশের পতাকার সাথে ছবি তোলা নিয়ে আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। স্যারদের সঙ্গেও বেশ কয়েকটা গ্রুপ ফটো তোলা হলো। ছবিগুলো সব শামীম তুলছিলো।
একটু পরেই প্যারেড শো শুরু হলো। ভারত এবং বাংলাদেশের সৈনিকেরা চমৎকার করে প্যারেড শো করছিল। যখন দেখলাম দুই দেশের পতাকা এক হয়ে আসছে, তখন বুকের ভেতর দেশপ্রেমের এক অদ্ভুত টান অনুভব করলাম। দুই দেশের নাগরিকরা তাদের দেশের নামে জয়ধ্বনি করছে দেখে আবেগে আপ্লুত হলাম। প্যারেড শো শেষ হওয়ার পর আমরা বাসে করে আবারও গেস্ট হাউজের দিকে এলাম। যেটার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটারের মতো।
সন্ধ্যায় সবাই ফ্রেশ হয়ে তৈরি হলাম মূল আকর্ষণ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার জন্য। ফিল্ড ওয়ার্কে প্রতিটি কাজের জন্য কেউ না কেউ দায়িত্বরত ছিলেন। সবাই তাদের জায়গা থেকে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি, বন্যা আর জয় ছিলাম সাংস্কৃতিক কমিটির। আমরা আয়োজন শুরু করে দিলাম গেস্ট হাউজের প্রথম তলায় একটি রুমে। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় পৌশির দুর্দান্ত নাচ সবার মন কেড়ে নিলো। এরপর বাদশা, শোভন এবং প্রিয়দের একক অভিনয়ে হাস্যমুখর হয়ে উঠেছিল অনুষ্ঠানটি। অনেকে দলীয় সংগীত, নাশিদ, আবৃত্তি করলো। সাওন ও শোভনের গানও অত্যন্ত চমৎকার ছিল।
সবশেষে লটারির আয়োজন করি। এ বছর প্রায় ২০টির মতো পুরস্কার রেখেছিলাম। তাতে আমাদের দুই স্যারই পুরস্কার পেয়েছেন। সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো সুজয় স্যার তার কেনা লটারিগুলো, যারা সুন্দর পারফর্ম করেছেন; তাদের উপহার দিয়েছেন। পঞ্চগড়ের সমস্ত আয়োজন সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মাধ্যমেই শেষ হয়। এরপর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাই। পরদিন দিনাজপুর ভ্রমণ শেষে ট্রেনে করে আবারও খুলনায় ফিরে আসি।
ভূগোলে পড়ার সুবিধার্থে নতুন নতুন জায়গা যেমন চেনার সুযোগ হচ্ছে; তেমনই অনেক কিছু সম্পর্কে অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। এই যে আমরা নতুন জায়গা দেখতে পারলাম, জানতে পারলাম। তার জন্য আমাদের স্যারদের সহোযোগিতা ও অক্লান্ত পরিশ্রম জড়িয়ে আছে। তাই তাদের প্রতিও রইলো অনেক অনেক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।
এসইউ/এমএস