জাগো জবস

যেভাবে বিজেএস পরীক্ষায় সফল হলেন মহিউদ্দিন

যেভাবে বিজেএস পরীক্ষায় সফল হলেন মহিউদ্দিন

ফাহিম হাসনাত

Advertisement

নরসিংদীর আলোকবালীর মহিউদ্দিন। সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নেওয়া তরুণ। নিজের কঠোর পরিশ্রম আর বড় ভাইয়ের স্বপ্নপূরণের অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে অর্জন করেছেন সাফল্য। সম্প্রতি প্রকাশিত ১৭তম বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, নানা বাধা-বিপত্তি আর পরিবারের নিরন্তর সমর্থন।

মহিউদ্দিনের পারিবারিক জীবন বেশ বড়। বাবা-মা ছাড়াও পরিবারে আছেন দুই ভাই-তিন বোন। তার বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ছোট ভাই বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ২০১৬-১৭ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন মহিউদ্দিন।

সাফল্যের এ পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। ১৫তম প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রথমবার ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আরও দ্বিগুণ উদ্যমে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ১৬তম বিজেএসের প্রিলিমিনারি ও ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও শেষ পর্যন্ত সুপারিশপ্রাপ্ত হননি। হাল ছাড়েননি মহিউদ্দিন। অবশেষে ১৭তম বিজেএস পরীক্ষায় স্বপ্নপূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

Advertisement

মাস্টার্স শেষ করার পর ২০২২ সাল থেকে পুরোদমে জুডিসিয়াল সার্ভিসের প্রস্তুতি শুরু করেন মহিউদ্দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে নিয়মিত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে হলের রিডিং রুম এবং নিজের কক্ষেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন।

প্রস্তুতির শুরুতে আইনের বিষয়গুলো ভালোভাবে বোঝার জন্য ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইয়ের কাছে নিয়মিত পড়তেন। পাশাপাশি জেনারেল অংশের প্রস্তুতির জন্য একটি কোচিং সেন্টারে কিছুদিন ক্লাসও করেছিলেন, যা তার জন্য বেশ সহায়ক ছিল বলে জানান তিনি। বাজারের বিভিন্ন সহায়ক বইয়ের পাশাপাশি মূল আইন অর্থাৎ বেয়ার অ্যাক্টের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বারবার পড়েছেন।

প্রিলিমিনারি পরীক্ষার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন বলেন, ‘অধিকাংশ পরীক্ষার্থী প্রিলিতেই বাদ পড়েন। তাই প্রিলির জন্য মূল আইনগুলো বারবার পড়ার সময় নিজে নিজে প্রশ্ন তৈরি করে রিভিশন দিতাম। প্রথমবার ব্যর্থ হলেও পরের দুইবার আর অসুবিধা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রিলি পরীক্ষার সময় নার্ভাসনেস এবং মানসিক চাপ অনুভব করা স্বাভাবিক। কারণ এত বিশাল সিলেবাস একদিনে মনে রাখা কঠিন।’

লিখিত পরীক্ষার অভিজ্ঞতাকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যায়িত করে মহিউদ্দিন জানান, টানা দশদিন পরীক্ষা দেওয়াটা সত্যিই কঠিন। একটি পরীক্ষা খারাপ হলে তার প্রভাব পরের পরীক্ষার ওপর পড়ে। এ সময় নিয়মিত খাওয়া ও ঘুম কোনোটাই সম্ভব হয় না।

Advertisement

সফলতার মূলমন্ত্র হিসেবে মহিউদ্দিন বারবার মূল আইন (বেয়ার অ্যাক্ট) পড়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রিলি, রিটেন ও ভাইভা–সব পরীক্ষার জন্যই বেয়ার অ্যাক্ট ভালোভাবে আয়ত্ত করা অপরিহার্য। পরীক্ষার আগে শুধু বেয়ার অ্যাক্ট রিভিশন দেওয়াই যথেষ্ট। কারণ গাইড বই শেষ করা কঠিন। জেনারেল অংশের প্রস্তুতির জন্য রিটেন-ভিত্তিক পড়াশোনার পরামর্শ দেন তিনি। প্রিলি ও রিটেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো প্রিলির আগেই রিটেনের মতো করে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেন।

আরও পড়ুন বিদেশে পড়তে যাওয়ার পর যেসব বিষয় জানা জরুরি  জাপানের মেক্সট বৃত্তিতে পড়তে যা করবেন 

এ সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যার, তিনি হলেন মহিউদ্দিনের বড় ভাই। মহিউদ্দিন অকপটে স্বীকার করেন, তার এই দীর্ঘদিনের পরিশ্রম মূলত বড় ভাইয়ের স্বপ্নপূরণ করার জন্যই। ভাইকে খুশি করতে পেরে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। পাশাপাশি বাবা-মায়ের জন্য কিছু করতে পারার সুযোগ পাওয়ায় তিনি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বড় বোন, বন্ধু এবং বান্ধবীরাও সব সময় তাকে সাহস ও সমর্থন জুগিয়েছেন।

অনার্স শেষ করার পর মহিউদ্দিন অনুভব করেছিলেন, ভাইয়ের জন্য তিনি কিছুই করতে পারেননি। ভাইকে খুশি করার একমাত্র পথ হিসেবে তিনি ফার্স্ট ক্লাস ক্যাডার অথবা জুডিসিয়ারিকেই বেছে নিয়েছিলেন। বিজেএসের জন্য তার ভাই তাকে অনেক উৎসাহিত করতেন এবং গণিতে ভালো করার জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতেন। তবে একসময় গণিত ও বিজ্ঞান তার কাছে কঠিন মনে হতে শুরু করে।

অন্যদিকে, আইন বিষয়ে অনার্স শেষ করেও নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অনুভব করতেন মহিউদ্দিন। মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পর যখন দেখেন তার অনেক সহপাঠী জুডিসিয়ারির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তিনিও একটি গ্রুপে যুক্ত হতে চান। তবে দুর্বল ফলাফলের কারণে কিছু বন্ধু প্রথমে তাকে সেই গ্রুপে নিতে দ্বিধা বোধ করেন। শেষ পর্যন্ত নিজের মতো আরও চারজন বন্ধুকে নিয়ে শূন্য থেকে পড়াশোনা শুরু করেন।

প্রিয় শিক্ষক মীর মাশরুর আহমেদের কাছে পড়া শুরু করার পরও নিজের ওপর তেমন আস্থা ছিল না মহিউদ্দিনের। তবে মীর মাশরুর আহমেদ প্রতিনিয়ত তাদের উৎসাহিত করতেন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দিতেন। তার অনুপ্রেরণামূলক কথাগুলো একসময় স্বপ্নের মতো মনে হতো মহিউদ্দিনের কাছে। মীর মাশরুর আহমেদের সান্নিধ্যে কয়েক মাস পড়াশোনা করে আইন বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেন।

প্রথমবার প্রিলি পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেও হতাশ হননি মহিউদ্দিন। মীর মাশরুর আহমেদের শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ১৬তম বিজেএসের প্রিলি, রিটেন ও ভাইভা দিলেও নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত থাকায় সেবার সফল হননি। এরপর তিনি বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় প্রথমবারই উত্তীর্ণ হন, যা তার আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেয়। তখন থেকেই তিনি জুডিসিয়ারিকে নিজের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেন। এ সময় তার বন্ধু মহিউদ্দিন মাহমুদ এবং জিবন নাহার তাকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন।

১৭তম বিজেএসের যাত্রা মহিউদ্দিনের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। রিটেন পরীক্ষার শুরুতে জেনারেল বিষয়গুলোর পরীক্ষা আশানুরূপ না হওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তবে আইনের পরীক্ষাগুলোতে ভালো করায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। বন্ধু শাপোন আকন তার অভিজ্ঞতা শুনে সাহস জুগিয়েছিলেন। প্রথমদিকের খারাপ পরীক্ষাগুলোর জন্য দুশ্চিন্তা কাটানো কঠিন হলেও শেষ পর্যন্ত নিজের পরিশ্রম আর সবার সমর্থনে সাফল্যের বন্দরে পৌঁছেছেন মহিউদ্দিন।

মহিউদ্দিনের এ সাফল্যের গল্প কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং পারিবারিক অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার এ অর্জন নিঃসন্দেহে অন্য তরুণদেরও স্বপ্ন দেখতে এবং সেই স্বপ্নপূরণের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে।

লেখক: ফিচার লেখক।

এসইউ/জিকেএস