জাগো জবস

বিসিএস জয়ের গল্প শোনালেন তৌহিদ

বিসিএস জয়ের গল্প শোনালেন তৌহিদ

তৌহিদ হোসেন সাতক্ষীরার সন্তান। তিনি আলিপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সাতক্ষীরার ইউনাইটেড মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিষয়ে স্নাতক পাস করেন। তিনি ৪১তম বিসিএসে আনসার ক্যাডার (মেধাক্রম-৪) পেয়েছেন। তার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। অনুলিখন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

Advertisement

আমি তৌহিদ হোসেন। আমার বাবা ছিলেন একটি বাজারের নাইটগার্ড। আমার মা একজন গৃহিণী। আমরা তিন ভাই। বড় ভাই মহিদ হোসেন এখন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে কিশোরগঞ্জে চাকরি করেন। ছোট ভাই নাহিদ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যয়নরত। ছোটবেলা থেকে সংসারের টানাপোড়েন দেখে এসেছি। এমনকি মাঝে মাঝে তিনবেলা কী খাবো, সেটার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে মা বাড়িতে আমাকে আর ভাইয়াকে বর্ণমালা শেখাতেন। হাতে ধরে ধরে শ্লেটে পেন্সিল দিয়ে লেখাতেন। মা মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ২০ টাকা ফিতে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে রেজাল্ট খুবই খারাপ ছিল। এখনো মনে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে রোল ছিল ৩৬। পরীক্ষার আগে এক সহপাঠীকে বললাম, ‘আমাকে একটু ইংরেজি দেখাবি?’ সে বলল, ‘না, আমি তোরে দেখাতে যাব কেন?’ সেদিন আমার খুবই খারাপ লাগছিল। তারপর পড়ালেখায় একটু মনোযোগ দিলাম। তৃতীয় শ্রেণিতে আমার রোল হলো চার। এরপর প্রতি মাসে ৫০ টাকা ফিতে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলাম। আমার ভাইয়াও সেখানে ভর্তি হলেন। চতুর্থ শ্রেণিতে রোল হলো দুই। পঞ্চম শ্রেণিতে আমার রোল হলো এক।

‘বাংলাদেশে মেয়েদের শিক্ষা’ নামে একটি রচনা প্রতিযোগিতায় উপজেলায় প্রথম স্থান এবং সাতক্ষীরা জেলায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলাম। তারপর পঞ্চম শ্রেণিতে সাধারণ বৃত্তি পেলাম। বৃত্তির টাকা দিয়ে ১০০ কেজি চাল কিনেছিলাম। তখন চাউলের দাম ছিল ১৬ টাকা কেজি। এরপর টাকা দিয়ে মায়ের কানের দুল বানিয়ে দিয়েছিলাম। আমার নানা-নানি না থাকলে আমাদের পড়ালেখা তো দূরের কথা, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে পড়তো। নানা লোকের ক্ষেতে মজুরি খাঁটতেন। সেখান থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান দিতেন। আমি আর ভাই একসাথে স্কুলে যেতাম, খেলতাম, পড়তাম এবং ঘুমাতাম। ভাইয়া ছিলেন আমার দুই ক্লাস ওপরে। বাড়ি থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে আলিপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভাইয়া আর আমি হেঁটে হেঁটে যেতাম-আসতাম। তারপর একটি পুরাতন সাইকেল জোগাড় হলো। ভাইয়া চালাতেন আর আমি পেছনে বসে থাকতাম। এসএসসিতে বাণিজ্য বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে ভাইয়া তার স্কুলজীবন শেষ করলেন। আমি একা হয়ে গেলাম। অষ্টম শ্রেণিতেই আমার প্রাইভেট পড়া শেষ। ৫-৭ মাসের প্রাইভেটের বেতন বাকি থাকতো। তা-ও কোচিং সেন্টারের অলিউল স্যার কোনোদিন বড় কথা বলেননি। এরপর থেকে পড়াগুলো ভাইয়ার কাছ থেকেই দেখিয়ে নিতাম। আমি না চাইলেও আমাকে ছাড়তো না। বন্ধু উজ্জ্বলের সাইকেলে স্কুলে যাওয়ার জন্য সকালে গিয়ে তার বাড়িতে বসে থাকতাম। এভাবে নবম-দশম শ্রেণি শেষ করলাম। এসএসসিতে বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হলাম।

Advertisement

তারপর ভর্তি হলাম সাতক্ষীরার ইউনাইটেড মডেল কলেজে। নাম ওয়েস্টার্ন মনে হলেও কলেজটি ছিল টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি। এখনো এমপিও হয়নি। সেখানে ভাইয়াও পড়তেন। এজন্য আমার বই, বেতন সবই ছিল ফ্রি। ভাইয়া এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে বের হলেন। এরপর থেকে কলেজে ঠিকমতো যাওয়া হতো না। স্থানীয় একটি হাফেজি মাদ্রাসায় বেশি সময় কাটাতাম। এ ক্ষেত্রে হাফেজ আব্দুর রহমান ছিল আমার বন্ধু এবং ওস্তাদ। এভাবে কলেজের টেস্ট পরীক্ষা এলো। আমি টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি। বোর্ড পরীক্ষার সময় পুরাতন সাতক্ষীরার নিরালা ছাত্রাবাসে ভাইয়ার সাথে থাকতাম। এরপর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হলাম।

আরও পড়ুন বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পেতে যেভাবে প্রস্তুতি নেবেন কর্মজীবী নারীরা কতটা নিরাপদ?

এইচএসএসির পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। সার্বক্ষণিক ভাইয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকতাম। ভাইয়া টিউশনি করাতে চলে যেতেন। অন্যদের বলে যেতেন আমার দিকে খেয়াল রাখার জন্য। আমার খরচ এবং পরিবারের খরচের বেশিরভাগই তখন ভাইয়া বহন করতেন। এরপর ২০১৩-১৪ সেশনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলাম। চান্স পাওয়ার খবর পেয়ে আমি রাস্তা থেকে দৌড়ে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম। ভর্তি হয়ে বরাদ্দ পেলাম কবি জসীম উদ্দীন হল। সেখানে ৫ বছর ছিলাম। হলে ৫ বছর ফ্লোরিং করেছি। ডিপার্টমেন্টের রেজাল্ট ভালো ছিল না। পড়ালেখা বাদ দিয়ে কুরআন, হাদিস অধ্যয়ন করতাম বেশি বেশি। মাঝে মাঝে কবিতাও লিখতাম। এরমধ্যে আমার রুমমেট বড়ভাই শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেন। তখনই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন জেঁকে বসলো। তাকে দেখলেই দূরের কোনো অস্পর্শনীয় প্রদীপ মনে হতো।

এক বড়ভাই আমাকে বিসিএস প্রিলিমিনারির গণিত এবং বিজ্ঞান বই গিফট করেছিলেন। তারপর পড়ালেখা একটু একটু করে শুরু করলাম। আমি তখন মূলত চতুর্থ বর্ষের শেষ পর্যায়ে। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য একমুহূর্তের জন্যও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে প্রবেশ করিনি। হলের রিডিং রুমে সবমিলিয়ে ২০-২৫ দিনের মতো গিয়েছিলাম। বিসিএস প্রস্তুতিতে কোনো কোচিং সেন্টারের বিন্দুমাত্র অবদান নেই। প্রিলিমিনারি, রিটেন ও ভাইভা কোনোটাই আমি কোচিংয়ের সংস্পর্শে যাইনি। আমি মূলত ৪১তম প্রিলিমিনারির সময় বাড়িতেই ছিলাম। প্রিলিমিনারি দিয়ে আবার বাড়িতে চলে এলাম। রেজাল্টের ২ মাস পরে ভাইয়ার ৩৮তম বিসিএসের দুটা পুরাতন রিটেনের বই বাংলা আর ইংরেজি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে একটা মেসে উঠলাম। তারপর আরও কিছু পুরাতন বই জোগাড় করলাম। রুটিন করলাম পড়ার জন্য। পড়া শুরু করলাম। আমি পড়ার চেয়ে রুটিন করতাম বেশি। রুটিনের ব্যত্যয় হলেই আবার রুটিন।

যে কোনো পরীক্ষার আগে একেবারেই একটা টাইট রুটিন করতাম। সেটা আমি ঘুম, খাওয়া বাদ দিয়ে শেষ করতাম। আমার বইপড়ার স্টাইলটা ছিল, আমি একটা বই শুরু করলে সেটা শেষ না করে অন্য বই ধরতাম না। তবে ইংরেজি এবং গণিত ছিল প্রতিদিনের ফিক্সড সাবজেক্ট। মেসের রুমে আমরা একই গ্রামের, একই স্কুলের ৪ জন থাকতাম। বড় ভাই, ছোটভাই সবাই মিলে রান্না করতাম, গানের আসর, লুডুর আসর বসাতাম। খিচুড়ি রান্নায় আমি ছিলাম সিদ্ধহস্ত। তাই সপ্তাহে অন্তত ২ দিন রাতে এটা রান্না না করলে যেন আমার পড়ার রুটিন অপূর্ণ থেকে যেত। বিসিএস রিটেনে পাস করলাম, ভাইভার ডেট পড়ে গেল। এরপর ৩টি বই কিনলাম। কোনোমতে একবার চোখ বোলালাম আর নিজের সাবজেক্ট একটু দেখে গেলাম।

Advertisement

ভাইভাও ভালো হয়েছিল। ৪১তম বিসিএসে তৃতীয় চয়েস আনসার ক্যাডারে চতুর্থ হই। যেদিন বিসিএসের রেজাল্ট দেবে; সেদিন সকাল থেকে কিছুই খেতে পারছিলাম না। মসজিদ থেকে জোহরের নামাজ আদায় করে এসে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। আছরের সময় হলো, তবুও পিএসসির মিটিং শেষ হয়নি। গেলাম আছরের নামাজে। গায়ে জ্বর এসে গেলো। কাঁথা গায়ে ফোনটা নিয়ে শুয়ে ছিলাম। এভাবে মাগরিবের নামাজ আদায় করে রুমে আসার পর রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। রেজাল্টে রোল আসার পর সর্বপ্রথম আমার রুমমেটদের এক এক করে জড়িয়ে ধরে আনন্দ করেছি! তারপর আমার বড়ভাইকে সংবাদটা দিয়েছিলাম। শুকরিয়া আদায়ের জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়েছিলাম। তারপর আম্মু, আব্বুকে জানিয়েছিলাম।

চাকরির পেছনের সবচেয়ে বড় মোটিভেশন হলো বাবা-মায়ের সাগরের মতো বিশাল হৃদয়ের নিঃস্বার্থ স্বপ্ন। তাদের সাথে প্রতারণা করবো না, এরকম প্রতিজ্ঞা করলেই চাকরির জন্য পড়ার স্পৃহা জাগতো। প্রত্যেক প্রতিযোগীর উচিত হবে সময়কে অযথা নষ্ট না করে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটানোর পাশাপাশি নিজের জীবনকে সুখময় করে তোলার জন্য সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। বেশি পড়ার চেয়ে গঠনমূলক পড়ালেখা করা জরুরি। ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং এবং ভোকাব্যুলারিতে বেশি জোর দিতে হবে।

এসইউ/এএসএম