সানজানা রহমান যুথী
Advertisement
আমরা ইতিহাসের সঙ্গে বাস করি। কখনো হই ইতিহাসের সাক্ষী। পুরোনো ইতিহাস জানি বই পড়ে। কখনো কখনো জাদুঘরে গিয়ে দেখি নিদর্শন। ফলে আমাদের সঙ্গে ইতিহাসের সেতুবন্ধ ঘটায় জাদুঘর। এই জাদুঘরের গুরুত্বকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে প্রতি বছর ১৮ মে পালন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস’। এটি অতীতের ঐতিহ্য, বর্তমানের শিক্ষা ও ভবিষ্যতের কল্পনাকে সংযুক্ত করার অনন্য উপলক্ষ।
জাদুঘরের ইতিহাস ও তাৎপর্য‘জাদুঘর’ শব্দটি বাংলা। এর ইংরেজি শব্দ ‘মিউজিয়াম’। যা এসেছে গ্রিক শব্দ ‘মুসেয়ন’ থেকে। অর্থ ‘মিউজেস’ বা জ্ঞান ও শিল্পকলার দেবীদের উপাসনালয়। প্রাচীন সভ্যতায় যেমন- মিশর, ব্যাবিলন, গ্রিস ও রোমে জাদুঘরের মতো কাঠামো দেখা গেছে। আধুনিক কালের জাদুঘরগুলো হয়েছে আরও পরিশীলিত, প্রযুক্তিনির্ভর ও দর্শকবান্ধব। একটি জাদুঘর শুধু পুরাতত্ত্ব বা শিল্পকলা সংরক্ষণের স্থান নয়—এটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের সূচনা১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ দিবসটি ঘোষণা করে। দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য ছিল—জাদুঘরগুলোর সামাজিক ভূমিকা বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে জাদুঘরের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা এবং বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা। প্রতি বছর নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্যের আলোকে দিবসটি পালিত হয়। যেমন- ‘শিক্ষা ও গবেষণার জন্য জাদুঘর’, ‘জাদুঘরের শক্তি’ কিংবা ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য জাদুঘর’।
Advertisement
এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য হলো—‘দ্রুত পরিবর্তনশীল সম্প্রদায়ে জাদুঘরের ভবিষ্যৎ’। এর লক্ষ্য হলো—আজকের বিশ্বের পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে জাদুঘরের ভূমিকা তুলে ধরা। বিশেষভাবে এটি তুলে ধরে যে কীভাবে জাদুঘরগুলো সমাজের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে মূল্যবান প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে—জাদুঘরগুলো কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, দূরদর্শী ও সম্প্রদায়ের প্রয়োজন অনুযায়ী সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, সেই দিকগুলো অন্বেষণ করা। পাশাপাশি এ বছরের প্রতিপাদ্যটি জাদুঘরকে এমন একটি স্থান হিসেবে গুরুত্ব দেয়; যেখানে মানুষ শিখতে পারে, ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে এবং নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
বাংলাদেশের জাদুঘরবাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জাদুঘর আছে। ঢাকা শহরে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, পুরাকীর্তি ও শিল্পকলা সংরক্ষণের বৃহৎ কেন্দ্র। এ ছাড়া আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, লালবাগ কেল্লা জাদুঘর, আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ জাদুঘর, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, জাদুঘর ও সংগ্রহশালার কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। আঞ্চলিকভাবে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, মাদারীপুর, বাগেরহাট, খুলনায়ও আছে ছোট-বড় বিভিন্ন জাদুঘর ও ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা। এসব স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
রমনা পার্কে কী আছে দেখার মতো এখনই উপযুক্ত সময় সুন্দরবন ভ্রমণের বর্তমানে জাদুঘরের চিত্রবর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষে জাদুঘরগুলো হয়ে উঠছে আরও আধুনিক। যুক্ত হয়েছে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, অগমেন্টেড রিয়্যালিটি, ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিসপ্লে ইত্যাদি। যার মাধ্যমে দর্শনার্থীরা একেবারে ভিন্নমাত্রায় ইতিহাসকে দেখতে পাচ্ছেন। বিশেষ করে কোভিড মহামারির পর ডিজিটাল মিউজিয়াম এবং অনলাইন প্রদর্শনী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি দর্শকদের কাছে ইতিহাসকে পৌঁছে দিচ্ছে। যারা হয়তো ভৌগোলিক বা আর্থিক কারণে শারীরিকভাবে জাদুঘরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশেও এ ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়ছে। জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল ট্যুর চালু করেছে। তবে এখনো অনেক দিকেই রয়েছে প্রযুক্তিগত ও কারিগরি ঘাটতি।
Advertisement
একটি জাদুঘর হতে পারে জীবন্ত পাঠশালা। ছোট-বড় শিক্ষার্থী, গবেষক কিংবা সাধারণ দর্শনার্থী জাদুঘরে এসে ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখতে পারেন। পাঠ্যবইয়ের শুকনো তথ্যের বাইরে এসে উপলব্ধি করতে পারেন—এ ভূখণ্ড কীভাবে গড়ে উঠেছে। আমরা কী হারিয়েছি এবং কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজগুলোতে যদি নিয়মিত জাদুঘর পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়, তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এ উদ্যোগ তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক সহনশীলতার শিক্ষা দেবে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাবাংলাদেশের জাদুঘরগুলো এখনো নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে চলছে। পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব, দক্ষ জনবলের সংকট, সংরক্ষণের আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি, দর্শনার্থী কম থাকা—এসবই জাদুঘরের প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা কাটাতে হলে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। জাদুঘরগুলোর আধুনিকীকরণ, ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি, জাদুঘর-কেন্দ্রিক গবেষণা এবং তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস হলো—নিজের শিকড়কে ছুঁয়ে দেখার, অতীত থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভবিষ্যতের পথ তৈরির। একটি জাতি যত বেশি তার ইতিহাসকে জানবে; তত বেশি সচেতন, সংবেদনশীল ও উন্নত হবে। এ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক—জাদুঘরকে শুধু ‘অতীতের মৃতভান্ডার’ নয় বরং আমরা যেন দেখি জীবন্ত শিক্ষা ও সংস্কৃতির আধার হিসেবে। কারণ একটি জাদুঘর যতটা অতীতের কথা বলে; ততটাই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়।
এসইউ/এমএস