তানজিলা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। রাজধানীর উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরে নিজেদের বাড়িতে থাকেন। ভাড়া দিয়েছেন চারটি ফ্ল্যাট। এক ভাড়াটিয়ার দুই মাসের ভাড়া বাকি। ভাড়া চাইতে গেলে উল্টো হুমকি দিচ্ছেন ওই ভাড়াটিয়া।
Advertisement
তানজিলা বলেন, ‘মামুন নামের এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীকে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছি। প্রথম দিন খুবই আন্তরিক আর ভালো ব্যবহার দেখে রাজি হয়ে যাই। এনআইডিসহ ডিএমপির ভাড়াটিয়া ফরমে তথ্য দেওয়ার কথা ছিল, আজও দেননি। এখন ভাড়া চাইতে গেলে উল্টো হুমকি দিচ্ছেন। সালিশে প্রতিশ্রুতি দিলেও ভাড়া দেননি, এখন ফ্ল্যাট দখলে নিতে চাইছেন।’
কথা হয় মামুনের সঙ্গে। বাড়ি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব অভিযোগ সত্য না। টাকা নাই, তাই ভাড়া দিতে পারিনি। ভাড়া দিয়ে দেবো। আমি দখলদার না, দখলে নিতে চাই না। আমরা রাত ১টা বা ২টার দিকে বাসায় ফিরলে সিকিউরিটি গার্ড ঝামেলা করে, কেন? আমরা ভাড়াটিয়ারা যে কোনো সময়ই আসতে পারি।’
মগবাজারের আলাউদ্দিন ফ্ল্যাট ভাড়া দেন এক নবদম্পতির কাছে। বাসায় উঠেই প্রয়োজনীয় তথ্য, এনআইডি আর যৌথ (স্বামী-স্ত্রী) ছবি দেওয়ার কথা থাকলেও ভাড়াটিয়া তা দেননি এক বছরেও। ভাড়াটিয়া ফুয়াদ ছিলেন নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কর্মী। উল্টো দখল করে নেন ফ্ল্যাট। তবে ৫ আগস্টের পরদিনই ফিরে পেয়েছেন সেই ফ্ল্যাট।
Advertisement
এয়ারপোর্ট কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা তবিবুর। তিনি শফিউল্লাহ নামের এক ভাড়াটিয়ার কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া দেন। ভাড়ার প্রথম এক মাস ঠিকঠাক চললেও এখন অসহায় তিনি।
তবিবুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাসার ভাড়াটিয়া কোনো ডকুমেন্টস দেননি। রাত ২টা নাই, ৩টা নাই আসা-যাওয়া করেন। সব সময় বাসা খুলে দিতে হবে। অথচ ভাড়া নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল রাত সাড়ে ১১টার পর বাসার মেইন গেট বন্ধ থাকবে। এখন তারা প্রতি রাতেই দেরিতে আসেন, প্রতিবাদ করলেই স্থানীয়দের দিয়ে হুমকি দেন।’
আরও পড়ুন: মানবিক, অমানবিক বাড়িওয়ালা ভাড়া কমিয়েও মিলছে না ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালাদের সমস্যার কথা তো কেউ বলছেন না!মগবাজারের আলাউদ্দিন ফ্ল্যাট ভাড়া দেন এক নবদম্পতির কাছে। বাসায় উঠেই প্রয়োজনীয় তথ্য, এনআইডি আর যৌথ (স্বামী-স্ত্রী) ছবি দেওয়ার কথা থাকলেও ভাড়াটিয়া তা দেননি এক বছরেও। ভাড়াটিয়া ফুয়াদ ছিলেন নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কর্মী। উল্টো দখল করে নেন ফ্ল্যাট। তবে ৫ আগস্টের পরদিনই ফিরে পেয়েছেন সেই ফ্ল্যাট।
আলাউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার পেনশন ও ব্যবসার টাকায় কেনা ছিল ফ্ল্যাট। ভাড়াটিয়া সেজে ফুয়াদ সেটা দখলে নিয়েছিল। প্রথম দুই মাস ভাড়া পেলেও পরের প্রায় এক বছর কোনো ভাড়া দেয়নি, বাসার ধারে-কাছেও আমাকে যেতে দেওয়া হয়নি। উল্টো ভয়ভীতি ও মামলার হুমকি দেওয়া হতো।’
Advertisement
এ বিষয়ে ফুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
চাঁনখারপুল এলাকায় একটি ফ্ল্যাট মেস হিসেবে ভাড়া দেন সাবদান। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। আর এ সুযোগে কয়েকমাস ধরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষার্থী দখল করে নেন মেসটি। ভাড়াও দেন না, আবার নানাভাবে হুমকি-ধামকিও দিচ্ছেন। পুলিশের কাছেও অভিযোগ নিয়ে যেতে পারছেন না।
চাঁনখারপুল এলাকায় একটি ফ্ল্যাট মেস হিসেবে ভাড়া দেন সাবদান। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। এ সুযোগে কয়েকমাস ধরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষার্থী দখল করে নেন মেসটি। ভাড়াও দেন না, আবার নানাভাবে হুমকি-ধামকিও দিচ্ছেন। পুলিশের কাছেও অভিযোগ নিয়ে যেতে পারছেন না।
সাবদান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার কষ্টার্জিত অর্থে ফ্ল্যাট কেনা হয়েছিল। যেটার দখলে নিয়েছে কিছু শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কয়েকজন। আমাকে ভাড়া দেয় না। আবার নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে যাতে এলাকায় যেতে না পারি। পুলিশের কাছেও অভিযোগ নিয়ে যেতে পারছি না।’
বাংলাদেশ মেস সংঘের মহাসচিব আয়াতুল্লাহ বলেন, ‘যে বা যারা ভাড়ায় এসে বাসা দখল করে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। মেস সংঘ সবার অধিকার নিয়ে কাজ করে। সবার আগে প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া উভয়ের সচেতনতা। ভাড়াটিয়াদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে কিছু জায়গায় গড়মিল দেখা যায়। বাড়ির মালিকের উচিত পরিবারের নম্বর রাখা, সবার তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য দিতে চান না অনেকে, এটা হলে তাকে ভাড়া না রাখাই ভালো।’
আরও পড়ুন: বাড়িওয়ালাকে হত্যা: ভাড়াটিয়ার দায় স্বীকার এক ফরমে তথ্য: দ্বিধায় ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালারা কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ভাড়াটিয়ার মেয়েকে হত্যা বাড়িওয়ালারশাহজাহানপুর উষা সংঘের সদস্য ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘প্রায় শুনছি চুরি হচ্ছে, ছিনতাই হচ্ছে। এগুলো তো ঢাকার বাইরে থেকে কেউ আসছে না। তারা তো ঢাকায়ই থাকেন, আপনার আমার বাসায়ই অবস্থান করছেন। তাহলে কেন তাদের তথ্য বাড়ির মালিক বা সংশ্লিষ্টরা থানায় দেবে না। এটা সন্দেহজনক বলা যায়। কারণ কে চুরি করছে, খুনের সঙ্গে জড়িত, গ্রেফতারের আগে বলতে পারি না। তাই সবার তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বাড়ির মালিকের কাছে থাকা উচিত।’
অপরাধ ও অপরাধীদের প্রসঙ্গে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ‘কোনো ফ্ল্যাট-প্লট নিয়ে কোনো সমস্যা হলে আমাদের মেডিয়েশন সেলের মাধ্যমে সমাধান করি যদি তারা রিহ্যাব সদস্য হন। ভাড়াটিয়াদের নিয়ে আমরা সমাধান দিতে পারি না। কিছু ভাড়াটিয়া এমন করলে অন্যদের ক্ষেত্রেও সেটার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে কেউ যদি কোনো অন্যায় করেন তবে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে হবে।’
‘ভাড়াটিয়ার প্রাথমিক তথ্য, এনআইডি, ছবি, অফিস আইডি রাখা দরকার অবশ্যই। কারণ কোনো অঘটন ঘটানোর আগেই তার মনে হবে যে, সব তথ্য তো নিকটস্থ থানা ও বাড়ির মালিকের কাছে আছে। রয়েছে সিসি ফুটেজ। এতে অপরাধ করার আগেই ভয়ে থাকবে অপরাধী কিংবা অনেক ক্ষেত্রেই সাহস পাবে না অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে।’- অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক
এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, ‘যে ভাড়াটিয়া ভাড়া না দিয়ে বাসা মালিককে হুমকি দেন, দখলের কথা ভাবেন তাকে আমরা ভাড়াটিয়া বলি না, তারা দখলবাজ। আমরা যেমন ভাড়াটিয়ার পক্ষে কথা বলি, একইভাবে কোনো অন্যায়ের শিকার হলে বাসার মালিকের পক্ষেও আমরা সহযোগিতার হাত বাড়াই।’
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাউনিয়া ও উত্তরা এলাকায় ভাড়াটিয়ারা ব্যক্তিগত তথ্য দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। বাড়িওয়ালাও কোনো অভিযোগ দেন না। তবে এটা এখন দেখা হচ্ছে, আগের মতোই তথ্য দিতে হবে। যাতে কোনো অপরাধী ভাড়াটিয়া সেজে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে।’
আরও পড়ুন: বাসা দেখতে গিয়ে বাড়িওয়ালার ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ গোপালগঞ্জে দিনদুপুরে ডাকাতি, বাড়িওয়ালার একমাত্র ছেলেকে হত্যাঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাড়াটিয়াদের ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে তাদের তথ্য নেওয়া হয়। এখন রাজধানীর প্রতিটি এলাকার কী অবস্থা তা দেখে সবকিছু ঠিক করা হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাড়াটিয়ার প্রাথমিক তথ্য, এনআইডি, ছবি, অফিস আইডি রাখা দরকার অবশ্যই। এক্ষেত্রে বাড়িওয়ালার সচেতনতা আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা দরকার। এতে হয়তো সব অপরাধ কমে যাবে না, তবে অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ কোনো অঘটন ঘটানোর আগেই তার মনে হবে যে, সব তথ্য তো নিকটস্থ থানা ও বাড়ির মালিকের কাছে আছে। রয়েছে সিসি ফুটেজ। এতে অপরাধ করার আগেই ভয়ে থাকবে অপরাধী কিংবা অনেক ক্ষেত্রেই সাহস পাবে না অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে।’
তৌহিদুল হক আরও বলেন, প্রতিটি বাসা মালিকের উচিত প্রত্যেক ভাড়াটিয়ার তথ্য সংগ্রহে রাখা এবং তথ্যের একটা অংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রাখা। এতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকে। আবার বাসা দখল বা চুরি-ছিনতাই করে অপরাধী লাপাত্তা হলেও তাকে পাকড়াও করা যাবে সহজেই। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা চ্যালেঞ্জে। এক্ষেত্রে সবার তথ্য সংগ্রহে মালিক ও ভাড়াটিয়ার সচেতনতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সহযোগিতা করতে হবে। এতে অপরাধ কমে আসবে, অপরাধীও চিহ্নিত হবে।’
ইএআর/এসএনআর/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম