জাঁকজমক আয়োজনে আবারও শুরু হয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসব। এই উৎসবের বিচার প্রক্রিয়া বরাবরই বেশ গোপন আর নিখুঁত হয়ে থাকে বলে সুনাম আছে। প্রতিবার মে মাসে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন এই উৎসবে আট-নয়জন প্রখ্যাত নির্মাতা, অভিনেতা, লেখক কিংবা সমালোচক জড়ো হন – একটি ছবিকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণার দায়িত্বে।
Advertisement
১২ দিনের ভেতর তারা দেখেন প্রায় ২০টির মতো সিনেমা। সেখান থেকেই সেরা সিনেমাকে উৎসব শেষে দেওয়া হয় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাম দর বা স্বর্ণপাম।
তবে হলিউড রিপোর্টার দাবি করছে, অনেক গোপনীয়তা আর স্বচ্ছতার মধ্যেও একে একে ১২ বার ভুল ছবিকে পুরস্কার দিয়ে বসেছে কান কর্তৃপক্ষ! অনেক সময়ই দেখা গেছে শিল্প-সাহিত্য, কল্পনা-বাস্তবের দারুণ মিশেল সৃষ্ট কোনো ছবিকে অবহেলা করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে দুর্বল ছবিকে।
পুরস্কার না পেলেও কালজয়ী হয়ে আছে ‘ক্লেও ফাইভ টু সেভেন’ সিনেমাটি
Advertisement
১৯৫৬ সালে উপেক্ষিত হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ফরাসি নাবিক জ্যাক কুস্তো ও তরুণ লুই মাল পরিচালিত ডকুমেন্টারি ‘দ্য সাইলেন্ট ওয়ার্ল্ড’ তখনকার দিনে রঙিন পানির নিচের দৃশ্য দিয়ে দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। একই বছরে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ও অংশ নিয়েছিল। সময়ের স্রোতে সিনেমাটি আজ কালজয়ী মানবিক চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। কান উৎসব কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে ‘সেরা মানবিক দলিল’ পুরস্কার দিয়ে সত্যজিৎ রায়কে সম্মান জানালের প্রধান পুরস্কার0 যায় ফ্রেঞ্চ পরিচালকের হাতে। সেটা নিয়ে আজও অনেক তর্ক।
১৯৫৭ সালে উপেক্ষিত বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেনথ সিল’সুইডিশ পরিচালক ইংমার বার্গম্যানের এই সিনেমা ইউরোপীয় প্লেগ মহামারির পটভূমিতে তৈরি। মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলা এক নাইটের গল্প সময়ের অন্যতম দার্শনিক চলচ্চিত্র হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তখন এটি শুধু বিচারকদের বিশেষ পুরস্কার পেয়েছিল, প্রধান পুরস্কার জোটেনি।
১৯৫৯ সালে ‘ব্ল্যাক অর্ফিয়াস’ বনাম ‘দ্য ৪০০ ব্লোস’ব্রাজিলের কার্নিভ্যালে ইউরো-কল্পনায় নির্মিত ব্ল্যাক অর্ফিয়াস হয়তো রঙিন ও সুরেলা ছিল কিন্তু ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ‘দ্য ৪০০ ব্লোস’ কিংবা আলেন রেনের ‘হিরোশিমা মন অ্যামোর’ – এই দুটো ছবিই ছিল ফরাসি নিউ ওয়েভের মাইলফলক। আজ ক্যামুর ছবিটি প্রায় বিস্মৃত, কিন্তু ত্রুফোর সৃষ্টি চিরকালীন হয়ে আছে।
১৯৮৯ সালে বঞ্চিত হয় ‘ডু দ্যা রাইট থিংস’
Advertisement
১৯৬২ সালে পুরস্কার পায়নি আগনেস ভার্দার ‘ক্লেও ফাইভ টু সেভেন’ফরাসি নারী নির্মাতা আগনেস ভার্দার এই সিনেমাটি নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত। এটি ফরাসি নতুন ধারার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ। বাস্তব সময়ের কাঠামোয় নির্মিত হলেও এটি কোনো পুরস্কার পায়নি। সবাইকে বেশ অবাক করেছিল বিষয়টি।
১৯৮৬ সালে বঞ্চিত তারকোভস্কির ‘দ্য স্যাক্রিফাইস’বিশ্বখ্যাত রুশ পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির শেষ সিনেমা এটি। পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা, ঈশ্বর ও আত্মত্যাগ- এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই ছবিটি শুধু বিচারকদের বিশেষ পুরস্কার পায়। স্বর্ণপাম যায় অন্য এক ছবির ঝুলিতে।
১৯৮৭ সালে আশা জাগিয়েও শূন্যতায় ‘উইংস অব ডিজায়ার’বার্লিন শহরের এক দেবদূতের মানুষের প্রেমে পড়া ও তার মানবজীবন গ্রহণের গল্প। চিত্রনাট্য ও সিনেমাটোগ্রাফির কারণে এটি সিনেমাপ্রেমীদের কাছে আজও বিশেষভাবে সম্মানিত। কিন্তু তাও পাম দ’অর জয় থেকে বঞ্চিত হয়।
১৯৮৯ সালে ‘ডু দ্য রাইট থিং’ ফিরেছিল খালি হাতেকান উৎসবে তখন তরুণ সোডারবার্গের সাহসী স্বাধীন ছবি মন জয় করেছিল। কিন্তু স্পাইক লির ‘ডু দ্য রাইট থিং’ আমেরিকায় বর্ণবাদ নিয়ে নির্মিত এক বৈপ্লবিক সিনেমা হয়েও খালি হাতে ফিরেছিল। ছবিটি চূড়ান্তভাবে উপেক্ষিত হয় বলে মনে করেন সিনেমা বিশ্লেষকরা। বিচারকের প্রধান উইম ওয়েন্ডার্সের দিকে ইঙ্গিত করে স্পাইক লি তখন বলেছিলেন, ‘আমার লুইভিল ব্যাটে ওর নাম লেখা আছে।’
১৯৯২ সালে খালি হাতে ফিরল ‘দ্য প্লেয়ার’হলিউডের ভেতরের জটিলতা, ষড়যন্ত্র ও সিনেমা ব্যবসার কুৎসিত দিক তুলে ধরা হয় এই সিনেমায়। এতে অসংখ্য তারকা অংশ নেন। তবুও এটি প্রধান পুরস্কার জিততে পারেনি।
২০০১ সালে উপেক্ষিত ‘মুলহল্যান্ড ড্রাইভ’ইতালির এক পরিবারে সন্তানের মৃত্যু ঘিরে আবেগঘন গল্প বলেছে ‘দ্য সন’স রুম’। বেশ দারুণ ছবিটি। কিন্তু ওই বছরের প্রতিযোগিতায় ছিল ‘মুলহল্যান্ড ড্রাইভ’ এবং ‘দ্য পিয়ানো টিচার’ - এর মতো আধুনিক আর হৃদয়ছোঁয়া গল্পের দুটি সিনেমা। এ দুটি বিশ্ব সিনেমায় বিখ্যাত সৃষ্টি হিসেবে সুপরিচিত। লিভ উলমানের নেতৃত্বাধীন বিচারকমণ্ডলী হয়তো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তিনটি সিনেমার মধ্যে সেরাকে বাছাই করতে। তারা শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলেন ‘দ্য সন’স রুম’-কে। তবে আলোচনা হয় ওই ছবির চেয়ে বেশি যোগ্য ছিল ‘মুলহল্যান্ড ড্রাইভ’।
২০০৩: লারস ফন ত্রিয়েরের ‘ডগভিল’খোলা মঞ্চে রেখায় আঁকা একটি শহর- এমন অদ্ভুত পরিবেশে নির্মিত হয় এই সিনেমা। আমেরিকান সমাজ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য এবং নির্মাতার নিজস্ব স্টাইলের কারণে অনেকেই সিনেমাটিকে ‘যন্ত্রণা’ মনে করলেও এটি ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। পাম দ’অর না পেলেও সিনেমাটি এখন বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়।
‘ওল্ডবয়’ ছবির পুরস্কার না পাওয়া সবাইকে অবাক করেছিল
২০০৪ সালে আশা জাগিয়েও পুরস্কার পায়নি কোরিয়ান মাস্টারপিসজর্জ বুশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বার্তা ছিল মুরের তথ্যচিত্রে। বিশ্বজুড়ে সেই সময় সেটা ছিল আবেগময় এক প্রতিবাদ। কিন্তু একই প্রতিযোগিতায় ছিল পার্ক চ্যান-উকের ‘ওল্ডবয়’। প্রতিশোধের গল্পে দুনিয়া কাঁপানো এক সিনেমা। এটিকে কোরিয়ান সিনেমার মাস্টারপিস বলা হয়। সবাই ভেবে নিয়েছিলেন এই সিনেমাটিই কান উৎসবের সেরা হবে। কিন্তু পুরস্কার গিয়েছিল রাজনীতির পক্ষে, শিল্পের পথে নয়।
২০২২ সালে বঞ্চিত ‘ডিসিশন টু লিভ’স্ক্যান্ডিনেভিয়ান পরিচালক ওস্টলুন্ড দ্বিতীয়বারের মতো জিতে নেন কান উৎসবের সেরা ছবির পুরস্কার। কিন্তু একই বছর পার্ক চ্যান-উকের ‘ডিসিশন টু লিভ’ ছবিটি নিয়ে প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি। মনস্তাত্ত্বিক প্রেম ও তদন্তের নিখুঁত মিশ্রণের অসাধারন এক সিনেমা এটি। অথচ সেবার কানে কোনো পুরস্কারই পায়নি ছবিটি। অনেকেই তখন বলেছিলেন- কান কি তবে আবার ভুল করল?
এলআইএ/জিকেএস