রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে চলতি বোরো মৌসুম থেকে কার্যকর করা হয়েছে নতুন সেচ নীতিমালা। ফলে এর প্রভাব পড়েছে চাষাবাদে। পানি সংকটে চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি ১০ হাজার হেক্টরের ওপর জমি। এ কারণে কমছে ধান উৎপাদন। তবে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে ‘ডাবল লিফটিং’ পদ্ধতিতে পদ্মা নদীর পানি বরেন্দ্র এলাকায় সরবরাহ ও সেচ সম্প্রসারণ (ইআইডিএল) প্রকল্প।
Advertisement
এ প্রকল্পের আওতায় পদ্মা নদী থেকে (সাড়ে ১৮ কিলোমিটার দূর থেকে) পানি এনে প্রায় ১০ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে উপকৃত হবেন অন্তত ৩০ হাজার কৃষক। এরইমধ্যে শেষ হয়েছে প্রকল্পের ২০ শতাংশ কাজ। ২০২৭ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলে রাজশাহী বিভাগের কৃষি অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলোতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৭৫ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমিতে। তবে গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮৬৫ হেক্টর জমিতে বেশি বোরো ধান চাষ হয়। সব মিলিয়ে গত বছর ধান চাষ হয় তিন লাখ ৭৬ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে। তবে চলতি (২০২৪-২০২৫) অর্থবছর ধান চাষ কমেছে। এবছর ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৭৬ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে। তবে পানি সংকটের কারণে চাষ হয়েছে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার চাষ কমেছে ১০ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে।
এরমধ্যে রাজশাহী জেলায় কমেছে এক হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে। নওগাঁয় কমেছে ৫৪০ হেক্টর, নাটোরে তিন হাজার ৫০০ হেক্টর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে চার হাজার ২০৫ হেক্টর।
Advertisement
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) তথ্য বলছে, পানি সংকটে থাকা আট উপজেলায় সংস্থাটির মোট তিন হাজার ৫৮৮টি সচল গভীর নলকূপ রয়েছে। এরমধ্যে এক হাজার ৯৬০টি নলকূপ তীব্র পানি সংকটপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি নলকূপ ২৪ হেক্টর থেকে ৪০ হেক্টর জমিতে পানি সেচ সরবরাহ করতে পারে।
বিএমডিএর নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থিতিশীল রাখতে বছরে একটি গভীর নলকূপ মোট ১৯৬০ ঘণ্টা চালানো হবে। এরমধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত আসন্ন বোরো মৌসুমে একটি গভীর নলকূপ মোট ৯৮০ ঘণ্টা চলবে। ফলে এসব নলকূপের আওতাধীন জমিতে বোরো ধান চাষ অর্ধেক থেকে শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। ফলে পানি সংকটের কারণে এবার ধান চাষ হয়েছে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার ১০ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আবাদ কমেছে। তবে এই সংকট কাটাতে উদ্যোগ নিয়েছে বিএমডিএ।
আরও পড়ুন ঢাকা ও বরেন্দ্র এলাকায় নেমে যাচ্ছে পানির স্তর তীব্র পানি সংকটে বরেন্দ্র অঞ্চলে কমবে ধান চাষ বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায় নেপাল পানিশূন্য হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলবিএমডিএ বলছে, ৫৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ডাবল লিফটিং’ পদ্ধতিতে পদ্মা নদীর পানি বরেন্দ্র এলাকায় সরবরাহ ও সেচ সম্প্রচারণ (ইআইডিএল)’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইনটেক পাম্প স্টেশন গোদাগাড়ী পৌরসভা এলাকার জোত গোসাইদাস সারাংপুর থেকে বুস্টার-১ ও বুস্টার-২ পাম্প স্টেশন হয়ে দুধাই খালে পানি সরবরাহের জন্য এক হাজার মিলিমিটার ডায়ার এইচডিপিই পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। দুটি স্টেশন ক্রস করে খাড়িতে (জলাশয়) যাবে এই পানি।
প্রকল্পটি শেষ হলে এ অঞ্চলের ১০ হাজার ২৫০ হেক্টর অনাবাদি জমি নতুন করে চাষের আওতায় আসবে। ফলে ৩০ হাজার কৃষক উপকৃত হবেন। সেই সঙ্গে প্রতি বছর এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন বাড়তি ফসল উৎপাদন হবে। ফলে দেশীয় অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে আশা প্রকাশ করছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ।
Advertisement
বিএমডিএ গোদাগাড়ী-১ জোনের সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ সরকার জাগো নিউজকে জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তাই এ অঞ্চলের পানির সংকট কমাতে এবং কৃষি আবাদে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে ‘ডাবল লিফটিং’ পদ্ধতিতে পদ্মা নদীর পানি বরেন্দ্র এলাকায় সরবরাহ ও সেচ সম্প্রচারণ (ইআইডিএল)’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইনটেক পাম্প স্টেশন গোদাগাড়ী পৌরসভা এলাকার জোত গোসাইদাস সারাংপুর থেকে বুস্টার-১ ও বুস্টার-২ পাম্প স্টেশন হয়ে দুধাই খালে পানি সরবরাহ করে কৃষিজমিতে দেওয়া হবে। ১৮-২০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে এই পানি সরবরাহ করা হবে।
সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ আরও জানান, প্রকল্পের কাজটি করছে শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আরএফএল। এইচডিপি পাইপ দিয়ে ১২০ কিউসেক পানি সরবরাহ করা হবে। স্থাপন করা হবে ১২০টি এলএলপি পাম্প স্টেশন। এসব পাম্প থেকে কৃষকরা নতুন করে তাদের অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় এনে ফসল উৎপাদন করতে পারবেন। এতে বহু কৃষকের উপকার হবে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রায় ২০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর এলাকার কৃষক সুলতান ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবারও পানির জন্য জমি চাষ করতে পারিনি। প্রতি বছরই ধানের সময় অর্ধেকেরও বেশি জমি চাষ করতে পারি না। ফলে অনেক ক্ষতি হয়। কিন্তু প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে জমিগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো চাষ করতে পারবো।’
আরেক চাষি নাসির উদ্দিন বলেন, ‘জমি চাষে পানি সংকট অনেক আগে থেকেই। পানির অভাবে বেশিরভাগ জমিতে চাষ করতে পারি না। বিশেষ করে ধান চাষ করতে গেলে অনেক সমস্যা হয়। প্রকল্পটি হলে আমাদের উপকারে আসবে।’
এসআর/এমএফএ/জিকেএস