ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে একসময় নৌপথের বিকল্প ছিল না। এ অঞ্চলে আজও তা যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবেই আছে। তবে বর্তমান সময়ের মতো ব্রিটিশ আমলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বেসরকারি বিলাসবহুল লঞ্চের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
Advertisement
সেসময় দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু করা হয় বিশেষ স্টিমার, যা দুপাশের প্যাডেল দিয়ে পানি কেটে হুইসেল বাজিয়ে রাজকীয়ভাবে এগিয়ে চলতো নিজস্ব গতিতে। তাই এই স্টিমারকে বলা হতো ‘নদীর রাজা’।
কালের বিবর্তনে স্টিমারের সেই রাজকীয় ভাব হারিয়ে যায়। যাত্রী সংকটের দোহাই দিয়ে ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। অনেকটা নীরবেই থেমে যায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্য।
তবে সেই থেমে যাওয়া ইতিহাস আবার ফিরে আসার আশ্বাস দিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। শনিবার (১০ মে) তিনি বরিশাল সফরকালে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য পুনরায় স্টিমার সেবা চালুর সুখবর দেন। ঘোষণার পর থেকেই বরিশালের বাতাসে যেন ফিরে এসেছে পুরোনো সেই হুইসেলের শব্দ।
Advertisement
বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, ‘স্টিমারে ভ্রমণের কত স্মৃতি আমাদের! বাতাসে ভেসে আসতো স্টিমারের গগনবিদারী হুইসেল। মানুষ ছুটে যেতো ঘাটে। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। আবার স্টিমার চালুর উদ্যোগে আমি ভীষণ আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ।’ বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমল থেকে ঢাকা-কলকাতা নৌপথে চলাচল করতো প্যাডেল স্টিমার। এ ধরনের নৌযানের দুপাশে বিশালাকৃতির দুটি হুইল দিয়ে চালানোর জন্য এগুলোকে বলা হতো ‘প্যাডেল স্টিমার’। ১৯২৮ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ শিপইয়ার্ডে নির্মিত হয় স্টিমার পিএস মাহ্সুদ। এর পরের বছর পিএস গাজী ও পিএস অস্ট্রিচ নির্মাণ করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালে পিএস লেপচা এবং পাকিস্তান আমলে (১৯৫০ সালে) পিএস টার্ন নির্মাণ করা হয়।
এসব স্টিমার প্রথম দিকে কয়লা থেকে উৎপন্ন বাষ্পে চলতো। ১৯৮৩ সালে প্রতিস্থাপন করা হয় ডিজেলচালিত ইঞ্জিন। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসিতে প্যাডেল স্টিমারের সঙ্গে ২০১৪ সালে এমভি বাঙালি ও ২০১৫ সালে এমভি মধুমতি নামে দুটি মোটর নৌযান স্টিমার সার্ভিসে যুক্ত করা হয়। নব্বই দশকে আগুনে পুড়ে যায় গাজী স্টিমার। কয়েক বছর আগে টার্ন ও লেপচা সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব স্টিমার একসময় যেতো ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সময়ের আধুনিক লঞ্চের নান্দনিক সৌন্দর্যের কাছে পিছিয়ে পড়ে স্টিমার। স্টিমারের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বিশালাকার প্যাডেল হুইল। কাঠের অভ্যন্তর, দোতলা কাঠামো, প্রশস্ত বারান্দা ও প্রথাগত আসবাব। বিপরীতে বর্তমান সময়ের আধুনিক ইঞ্জিনচালিত এ নৌযান বহুতল ও অধিক গতিসম্পন্ন। অভ্যন্তরে আধুনিক প্লাস্টিক বা ধাতব আসবাব, কৃত্রিম আলো ও চমকপ্রদ সাজ। যে কারণে যাত্রী কমতে থাকে প্যাডেল স্টিমারে।
তবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আবেগের স্টিমার পুনরায় ফেরাতে আবার উদ্যোগ নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে শনিবার বিকেলে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা জানান নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
Advertisement
তিনি বলেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী স্টিমারসেবা আবার চালু হবে। এজন্য নৌপথে চলাচলকারী চারটি স্টিমার সংস্কারের কাজ চলছে। আগামী ৫-৬ মাসের মধ্যে অন্তত দুটি স্টিমার চালু করার পরিকল্পনা আছে। স্টিমারে ভ্রমণকারীদের জন্য এটি একটি বড় সুখবর হবে।
স্টিমার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা জানান, দুটি স্টিমার চালুর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমারের মধ্যে পিএস অস্ট্রিচ ও মাহসুদ ঢাকা-বরিশাল নৌপথে পর্যটকদের জন্য চলাচল করবে। এছাড়া পিএস লেপচা ও টার্ন বরিশাল-খুলনায় ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান বলেন, দুটি স্টিমার চালুর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরইমধ্যে চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিনে দুটি জাহাজ নির্মাণ শেষে সার্ভে প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষমাণ। তবে কবে নাগাদ চালু হবে, সপ্তাহে কতদিন চলবে, ঢাকা থেকে গন্তব্য কোন পর্যন্ত হবে এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
শাওন খান/এসআর/এমএস