লাইফস্টাইল

প্রজন্মগত মানসিক আঘাতের চক্র যেভাবে ভাঙবেন

প্রজন্মগত মানসিক আঘাতের চক্র যেভাবে ভাঙবেন

সোনালি বিকেলে হঠাৎ আনমনে কখনো কি শৈশবের কথা মনে পড়ে? কেমন অনুভূতি হয় তখন? হালকা উষ্ণ নস্টালজিয়া, নাকি মনে পড়ে যায় গভীর কোনো ক্ষতের স্মৃতি?

Advertisement

অনেকেই বলবেন, তারা শৈশবের সরলতা, স্বাধীনতা আর বাবা-মা, ভাই-বোনের ভালোবাসায় ঘেরা সময়টা মিস করেন। সেই উষ্ণ স্মৃতিগুলো তাদের আজও আনন্দ দেয়। তারা তাদের স্মৃতিগুলো স্নেহের সঙ্গে স্মরণ করেন এবং অতীতের কথা ভেবে খুশি হন। তাই তাদের হয়তো মনে হবে– সেটাই তো স্বাভাবিক! অন্তত সমাজ সেটাই আশা করে।

কিন্তু বাস্তবতা সবসময় এমন আদর্শ জীবনের চিত্রকে অনুসরণ করে না। কিছু মানুষের জন্য শৈশব নেতিবাচক অর্থ বহন করে এবং সেটি এমন এক অতীত, যা আনন্দচিত্তে স্মরণ করা যায় না। এ রকম মানুষেরা নিজের শৈশব ভুলে থাকার চেষ্টা করেন।

আপনি যদি জেনারেশনাল ট্রমার বা প্রজন্মগত আঘাতের শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি জানেন, নিজ পরিবারে যে শিশুরা এ রকম ট্রমা অনুভব করে, তাদের জন্য এটি কতটা ক্ষতিকর। এ জন্যই আপনার ট্রমাকে মোকাবিলা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই চক্র ভাঙা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

প্রজন্মগত ট্রমা কী? মা-বাবা তাদের সন্তানকে বেঁচে থাকার সবকিছু দিয়ে থাকেন। এমনকি শিশুকে নিরাপত্তার অনুভূতি ও আনন্দ দেওয়ার দায়িত্বও তাদের। সেইসঙ্গে সন্তানের বেড়ে ওঠার পরিবেশটিও দেন তারা। এ সবই শিশুর বিকাশকে প্রভাবিত করে। তারা যে পরিবেশে বড় হয়, তার প্রভাবেই তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। তবে, মা-বাবা যা কিছু সন্তানদের দেন, তার সবই সুখকর নয়। তাদের নিজস্ব ট্রমা, এমনকি পরিবারের ইতিহাসের সমষ্টিগত ট্রমাও শিশুদের ওপর পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে।

প্রজন্মগত ট্রমা হলো এক ধরনের মানসিক আঘাত, যা একটি প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের মধ্যে অবচেতনভাবে বা আচরণগতভাবে সঞ্চারিত হয়। এটি তখনই ঘটে, যখন কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা সম্প্রদায়ের ওপর এমন কোনো গভীর আঘাত বা দুর্দশার প্রভাব পড়ে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সন্তান, নাতি-নাতনি বা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে জিনগত, মানসিক বা সামাজিকভাবে প্রকাশ পায়।

ট্রমা কীভাবে তৈরি হয়?

১. আচরণ ও পরিবেশের মাধ্যমে প্রবাহিত ট্রমা:মা-বাবা বা পূর্বপুরুষ যদি ট্রমাজনিত উদ্বেগ, হতাশা বা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে ওসব আচরণ শিশুরা অনুকরণ করতে শুরু করে। যেমন, একজন মা যদি অতীত নির্যাতনের কারণে সন্তানকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করেন, সন্তানও ভবিষ্যতে অন্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে পারে।

আমাদের আশপাশেই এ রকম দেখা যায়। এসবের পেছনে থাকতে পারে শৈশবের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, এমন একজন ব্যক্তি যখন তার শিশু সন্তানকে ছোট ছোট বিষয়ে শারীরিকভাবে আঘাত করতে থাকেন, তখন ওই শিশু বড় হওয়ার পরও তার মধ্যে এর প্রভাব থেকে যায়। নিজে ছোটবেলায় প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়ার পরও অনেক সময় তারা নিজেরা তাদের শিশুদের সঙ্গে ওই একই আচরণ করেন।

Advertisement

অনেকে শৈশবে বারবার মানসিক আঘাত পেলে সে বড় হয়ে কারও কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় না। এমন আঘাতপ্রাপ্ত মানুষদের বড় হয়ে নতুন সম্পর্ক তৈরি করতেও সমস্যা হয়।

২. জিনগত পরিবর্তন:গবেষণায় দেখা গেছে, ট্রমা মানুষের জিনগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ, ট্রমা শারীরিকভাবে ডিএনএতে প্রভাব ফেলে, যা পরবর্তী প্রজন্মে উদ্বেগ, হতাশা বা চাপবোধের প্রবণতা বাড়াতে পারে। যেমন, গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সন্তানদের মধ্যে ট্রমার জিনগত প্রভাব দেখা গেছে।

৩. অপ্রকাশিত ট্রমা:পরিবারের অব্যক্ত বা লুকানো ট্রমা (যেমন যুদ্ধ, দারিদ্র্য, নির্যাতন) পরোক্ষভাবে শিশুদের মধ্যে ভয় বা অস্বস্তি তৈরি করে। যেহেতু বিষয়টি কখনও প্রকাশ্যে আসে না, তাই এ নিয়ে কেউ খোলাখুলি কথা বলে না। ফলে শিশুদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার প্রবণতা দেখা দেয়।

ট্রমার বিভিন্ন দিক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে। ঘটনার স্মৃতি গল্পের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা পরিবারের সবার মধ্যে অতীতের জ্ঞান সৃষ্টি করে। কিন্তু যখন ট্রমার বিষয়বস্তু সরাসরি ভাগাভাগি করা হয় না, তখন তা অন্য উপায়ে প্রকাশ পায়। পরিবারের মধ্যে অসুস্থ আচরণের উৎস হতে পারে সেই ঘটনা, যা মূলত ট্রমাটিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।

৪. সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে:যারা চিকিৎসাহীন পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডারে (পিটিএসডি) ভোগেন, ট্রমার কারণে তারা নেতিবাচক অভ্যাসে ঝুঁকে পড়েন। যেমন, মাদকাসক্তি, পরিবারের প্রতি উদাসীনতা ইত্যাদি। যেসব বাবা-মা সন্তানের জীবনে মানসিকভাবে অনুপস্থিত থাকে, তাদের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়। এটি ভবিষ্যতে ওই সন্তানদের অনুভূতি প্রকাশ করতে সমস্যা তৈরি করে। যদি চিকিৎসা না করা হয়, তবে এই চক্র ট্রমার শিকার ব্যক্তিদের সুস্থতা এবং পারিবারিক সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই থাকে।

কোন লক্ষণগুলো দেখে সতর্ক হবেন?

১. সম্পর্কে অবিশ্বাস বা ভয়। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হওয়া।২. অতিরিক্ত সতর্কতা বা উদ্বেগে ভোগা। অকারণে আশঙ্কা হওয়া।৩. আত্মবিশ্বাসের অভাব। নিজের মূল্যায়ন নিয়ে সংশয়ে থাকা।৪. মাদকাসক্তিতে ঝুঁকে পড়া।৫. যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কিছু পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা।৬. অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা অস্বীকার করা ও আক্রমণাত্মক আচরণ করা।৭. অতিরিক্ত সতর্কতা ও সবকিছু নিয়ে বেশি চিন্তা করা, যাকে ওভার থিংকিং বলা হয়।

কীভাবে ভাঙবেন ট্রমার চক্র

১. ট্রমা চিনুন, পরিবারের ইতিহাস জানার চেষ্টা করুন। অতীত ঘটনাগুলোর কারণ ও ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করুন।২. নিজে না পারলে থেরাপি নিন, ট্রমা-সচেতন কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপি কার্যকর উপায় হতে পারে।৩. আপনার সন্তানদের সঙ্গে ইতিবাচক যোগাযোগ গড়ে তুলুন। যে আচরণ আপনার মধ্যে ট্রমা তৈরি করেছে, সচেতনভাবে সেসব এড়িয়ে চলুন।৪. নিজের যত্ন নিন। মেডিটেশন, আর্ট থেরাপি বা সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দিন। অথবা কাছের কোনো বন্ধুর সাহায্য নিন।৫. অতীত ঘটনাগুলোর প্রভাব স্বীকার করুন ও অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন।

প্রজন্মগত ট্রমা যতই ভয়ানক এবং গভীরভাবে গেঁথে থাকুক না কেন, মনে রাখবেন, চেষ্টা করলে এর থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। আপনার সঙ্গী, প্রিয় বন্ধু ও ভাইবোনদের সঙ্গে খোলামেলা ও সৎ যোগাযোগই হলো প্রথম পদক্ষেপ, যা আপনাকে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।

সূত্র: ট্রান্সফর্মেশনস্ কেয়ার নেটওয়ার্ক

এএমপি/আরএমডি/জেআইএম