ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান, সোচ্চার ছিলেন সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। আগেও নানান অনিয়মের বিরুদ্ধে ছেড়েছেন কণ্ঠ। নিজের লেখা প্রতিবাদে গানে মানুষকে যুগিয়েছেন প্রতিবাদের সাহস। সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর প্রতিবাদে সম্প্রতি ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এই শিল্পী। সমাজে ঘৃণা এবং সহিংসতার চর্চা বন্ধে নিজের অবস্থান জানিয়ে তিনি লিখেছেন—মব-জনতা উন্মাদনায় ভেসে যাচ্ছে জংলিপনায়।ফেসবুকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিসরে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণাত্মক ভাষা, অপমানজনক উপাধি এবং হত্যার হুমকির মতো প্রবণতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সায়ান। গতকাল (১২ মে) সোমবার দেওয়া ফেসবুক পোস্টে সায়ান বর্তমান সরকারকে ঘৃণা, সহিংসতা ও হত্যার হুমকির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কঠোর হওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা ঘৃণা চর্চার বয়ানকে চিহ্নিত করুন, আক্রমণাত্মক ভাষাভঙ্গি নিয়ে কাজ করুন। মানুষের জন্য মানবিক আচরণের ন্যূনতম একটা মানদণ্ড তৈরির কথা ভাবুন। বিভিন্ন মঞ্চে গিয়ে একে বেশ্যা, তাকে দালাল—এগুলো তো প্রতিদিনের ব্যাপার হয়েছে, তার সঙ্গে এই যে জবাই করার কথা বলা, “ধরে ধরে জবাই কর”, এটা পৃথিবীর যে কোনো সমাজে, যে কোনো রাষ্ট্রে কীভাবে গ্রহণযোগ্য? এভাবে ঘৃণা ও হত্যার হুমকির খুল্লামখুল্লা চর্চা চালিয়ে যাবে কেউ, তারপর সেটার কোনো পরিণতি হবে না, এটা কেন গ্রহণযোগ্য? এখানে তো ব্যক্তিকে হত্যা করার কথা বলা হচ্ছে। এটা কীভাবে স্বাভাবিক? এটা স্লোগান হিসেবে কেন আপত্তিকর নয়? হত্যার উসকানি নয়?’
Advertisement
সায়ান জানিয়েছেন, এ ধরনের ভাষা তিনি ২০১৩ সালে শুনেছেন, যখন গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলছিল। তখনো এসব শুনে তার ভালো লাগেনি। তিনি লিখেছেন, ‘বিচার চাওয়া আর জবাই করা এক ব্যাপার না। বিচারের সংস্কৃতিই সেটা নয়।’
আরও পড়ুন কৃষক-শ্রমিকের কাছে তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করলেন সায়ান কলকাতার ধর্ষণকাণ্ড, সায়ান গাইলেন, স্বস্তিকা জানালেন ভালোবাসাসায়ানের মতে, ‘ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ এখন সময়ের দাবি। এ প্রসঙ্গে শিল্পী লিখেছেন, ‘সাধারণ জনতার ভিড়ে সুশীলও থাকেন, উন্মাদ মব-জনতাও থাকেন। তাদের কাছে বাড়তি কিছু আশা করি না। তারা রাষ্ট্রের দায়িত্বে নেই। তারা যে যার নীতি-গতি-বিবেক অনুযায়ী আচরণ করবেন, সকলেরই দেশ, সকলেই স্বাধীন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিক থেকে তো আচরণের একটা মানদণ্ড থাকতে হবে। কেন একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে বেশ্যা ডেকে পার পাবেন? কেন যে কেউ যে কাউকে ভালো না লাগলেই জবাই করার হুমকি দেবেন এবং তার স্বাভাবিকীকরণ হবে? কেন বিভিন্ন মাহফিলে অন্য ধর্মের মানুষ ও মেয়েদের প্রতি ঘৃণার বয়ান ছড়াতে থাকবে যুগের পর যুগ? তাই একটা “ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ কমিশন” এখন সময়ের দাবি।’
সাম্প্রতিক এক উদাহরণ টেনে সায়ান লিখেছেন, ‘সেদিন দেখলাম কোনো এক মঞ্চ থেকে কেউ কেউ তালে তালে বলছেন, “একটা একটা লীগ ধর, ধরে ধরে জবাই কর।” রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা মানুষেরা কেন এই চর্চায় কোনো সমস্যা পাচ্ছেন না? মব-জনতা উন্মাদনায় ভেসে যাচ্ছে জংলিপনায়। কিন্তু রাষ্ট্রের নিযুক্ত সেবকেরা কী করে এখানে নির্বিকার থাকবেন? এগুলোকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে দেখতে চাই। কেউ অপরাধ করলে তার বিচার করবেন আদালতে। জবাই করার স্লোগানের মধ্যে ২০১৩ সালেও দেশপ্রেম ছিল না, এখনো নাই। বিচারের মানসিকতা ছিল না, এখনো নাই।’
Advertisement
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সায়ান লিখেছেন, ‘গা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে সংস্কৃতি পাল্টাবে না। কাজ করতে হবে, প্রচারণা করতে হবে। মানুষকে গালি দেওয়া এবং জবাই করার হুমকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব শেষ করা, এগুলো বন্ধ করতে হবে। সরকারকে বলছি, কাউকে কেউ কিছু বললেই গায়েবি মামলা দিয়ে তুলে নিয়ে যাবেন না। কোন কথাগুলো উগ্র-হিংসাত্মক ও আপত্তিকর, সেগুলোর তালিকা করেন। আইনিভাবে ঘৃণার চর্চা নিষিদ্ধ করেন। এটা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার জটিল প্রক্রিয়ার চেয়ে কিছুটা সহজ হবে করা। ঘৃণার চর্চাকে খাটো করে দেখবেন না। সেখান থেকে বৈধতা আসে বড় বড় অপরাধের।’প্রতিবাদী গানের শিল্পী হিসেবে সমাদৃত সায়ান। ২০০৮ সালে সায়ানের প্রথম গানের অ্যালবাম ‘সায়ানের গান’ প্রকাশিত হয়। তার দ্বিতীয় দ্বৈত অ্যালবাম ‘আবার তাকিয়ে দেখ’ এবং ‘স্বপ্ন আমার হাত ধরো’ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়। ‘জনতার বেয়াদবি’ গানটির জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন করে মানুষের সমর্থণ ও ভালোবাসায় যুক্ত হয় তার নাম।
আরএমডি/জিকেএস