স্বাস্থ্য

রোগ নির্ণয়ের নামে ইচ্ছেমাফিক ফি আদায় বন্ধ হবে কবে?

রোগ নির্ণয়ের নামে ইচ্ছেমাফিক ফি আদায় বন্ধ হবে কবে?

রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ রাহাত মজুমদার। অতিরিক্ত প্রস্রাবজনিত সমস্যার কারণে ধানমন্ডির ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের একজন ইউরোলজিস্ট অধ্যাপকের শরণাপন্ন হন। দেড় হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেখালে তিনি তার সমস্যা শুনে কোনো ধরনের ওষুধ না দিয়েই রোগ নির্ণয়ের জন্য ৮টি প্রয়োজনীয় (ইউরিন আরএমই, ইউরিন ফর কালচার, সিরাম ক্রিটেনিন, সিবিসি, এসপিএসএ,ইউরোফ্লোমেট্রি, আল্ট্রাসনোগ্রাম অফ দি কেইউবি উইথ পিভিআর ও এইচভিএওয়ানসি) টেস্ট করে দেখা করতে বলেন। দয়াপরবশ হয়ে প্রেসক্রিশনে পরীক্ষা নিরীক্ষায় ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার কথাও লিখে দেন ওই চিকিৎসক।

Advertisement

ল্যাবএইডের রিসেপশনে গিয়ে টাকার অংক শুনে রাহাত মজুমদারের গলা শুকিয়ে এলো। ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার পরেও পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করতে ৭ হাজার ৮৯৫ টাকা লাগবে বলে জানানো হলো তাকে। অভ্যর্থনাকারী হাসিমুখে জানালো, স্যার (চিকিৎসক) খুব ভালো মানুষ। ওনার জন্য ২০০০ টাকার মতো ছাড় পেলেন।

সঙ্গে টাকা না থাকার অজুহাত দেখিয়ে রাহাত মজুমদার ওই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসেন।

পরদিন রাহাত মজুমদার তার পরিচিত একজনের রেফারেন্সে মগবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ঐ একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় করাতে সমর্থ হন।

Advertisement

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে রাহাত মজুমদার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি বাবদ আদায়কৃত অর্থের তারতম্য দেখার কি কেউ নেই? মগবাজারের হাসপাতালগুলোতে তিনি ল্যাবএইড এর অর্ধেক মূল্যেই পরীক্ষাগুলো করালেন, এরপরেও মগবাজারের হাসপাতালটির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় লাভ রয়েছে।

রাহাত মজুমদার আরও জানান, বিভিন্ন সময় তিনি শুনেছেন হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্যতালিকা দৃশ্যমান স্থানে টানিয়ে রাখতে হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তিনি সে তালিকা দেখতে পাননি। বছরের পর বছর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো ইচ্ছামতো অর্থ আদায় করলেও বাস্তবে তা দেখবার করার কেউ নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন রাহাত মজুমদার।

শুধু রাহাত মজুমদার একা নন, রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে ইমারজেন্সি রোগীদের ক্ষেত্রে নিরুপায় স্বজনরা তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত টাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বাধ্য হন।

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে ইচ্ছেমতো ফি আদায় বর্তমানে একটি গুরুতর ও আলোচিত সমস্যা হলেও এদিকে কারো নজর নেই। একই ধরনের টেস্ট বা সেবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন হারে নেওয়া হচ্ছে, যা কোনোরকম নিয়ন্ত্রিত কাঠামো বা সরকার নির্ধারিত তালিকার অনুসরণ করছে না।

Advertisement

প্রধান অভিযোগসমূহের মধ্যে রয়েছে-

টেস্ট ফি’র অযৌক্তিক তারতম্য: কোনো একটি ব্লাড টেস্ট এক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৫০০ টাকা, আরেকটিতে ১৫০০ টাকা- এমন ভিন্নতা অহরহ দেখা যায়।

রেট চার্ট অনুপস্থিত: অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট ফি তালিকা টাঙানো থাকে না। ফলে রোগী আগেই জানতে পারেন না যে তার কতো খরচ হবে।

চিকিৎসকের সঙ্গে আঁতাত: কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়, যেখান থেকে চিকিৎসক কমিশন পান বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রশাসনিক নজরদারির অভাব: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কঠোর মনিটরিং না থাকায় এই অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।

জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে প্রধান করে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১২ সদস্যের স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতের দুর্বল শাসনব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগের বিষয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের ১৫ হাজার ২৩৩টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ১২৩টি লাইসেন্স নবায়ন করেছে এবং ১ হাজার ২৭টি লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। এতেই স্পষ্ট হয় যে, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল এবং আইন লঙ্ঘনের মাত্রা অত্যন্ত উদ্বেগজনক যা রোগীদের নিরাপত্তা ও পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিকার সংস্কার কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশব্যাপী একটি জরিপ পরিচালনা করে। দেশের ৮ বিভাগের ৮ হাজার ২৫৬ জন নাগরিকের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। সেখানে ৯৬ শতাংশ নাগরিক রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষার মূল্য নির্দিষ্ট করার পক্ষে মত দেন।

স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির জন্য কাজ করছেন এমন বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে ইচ্ছেমতো ফি আদায় একটি গুরুতর সমস্যা। এটি রোগীদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে এবং স্বাস্থ্যসেবার ওপর আস্থা কমিয়ে দেয়। এর সমাধানে নিচের উপায়গুলো কার্যকর হতে পারে-

সরকারি মূল্য নির্ধারণ ও এর কঠোর বাস্তবায়ন

প্রতিটি পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। এই মূল্য সারাদেশের প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টাঙিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটি লঙ্ঘন করলে জরিমানা, লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

নিয়মিত মনিটরিং ও অভিযান

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদারকি টিম গঠন করে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

লাইসেন্স নবায়নে শর্ত

প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়নের সময় রেটের নির্ধারিত তালিকা অনুসরণ করছে কি না, তা যাচাই করতে হবে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সক্রিয়তা

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্র চালু ও সহজলভ্য করতে হবে।

জনসচেতনতা বৃদ্ধি

মানুষকে জানাতে হবে যে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন। গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় মূল্যতালিকার অ্যাপ/ওয়েবসাইট

প্রতিটি টেস্টের নির্ধারিত মূল্যের তালিকা একটি সরকারি ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপে রাখতে হবে। সাধারণ মানুষ যাতে সহজেই যাচাই করতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবা নীতিমালা হালনাগাদ

জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি অনুযায়ী বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকরী বিধান যুক্ত করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক এ কে আজাদ খানের কাছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ইচ্ছেমাফিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য আদায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভেদে রোগ নির্ণায়ক মূল্যের পার্থক্য হতেই পারে। তবে তা কতোটুকু যৌক্তিক তা নির্ধারণের জন্য কাজ করা উচিত।

তিনি বলেন, কমিশন রি-এজেন্টের তিনগুণ মূল্যের বেশি ফি আদায় করা অনুচিত হবে বলে অভিমত দিয়েছে। তবে সঠিক মূল্য নির্ধারণ করার জন্য কাজ করতে হবে। এজন্য তারা স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য কমিশনের নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে না, তবে তারা স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন বিতর্কিত ও অনিয়মের বিষয়ে মনিটরিং ও সুপারভিশন করে সরকারকে পরামর্শ দেবে। এটি করা গেলে জনগন উপকৃত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এমইউ/এএমএ/এমএস