আন্তর্জাতিক

দুর্ভিক্ষের ‘গুরুতর ঝুঁকিতে’ গাজার ২১ লাখ বাসিন্দা

দুর্ভিক্ষের ‘গুরুতর ঝুঁকিতে’ গাজার ২১ লাখ বাসিন্দা

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বসবাসরত প্রায় ২১ লাখ ফিলিস্তিনি দুর্ভিক্ষের ‘গুরুতর ঝুঁকিতে’ রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মূল্যায়ন বিষয়ক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)।ইসরায়েলের অব্যাহত অবরোধের মুখে ত্রাণ ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা ঢুকতে না পারার কারণে সেখানকার বাসিন্দারা চরম খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংস্থাটি। খবর বিবিসির।

Advertisement

ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি মূলত জাতিসংঘ, দাতা সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি সংস্থা, যাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহল একটি এলাকায় দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে কি-না, সেটার প্রাথমিক মূল্যায়ন করে থাকে।

সোমবার প্রকাশিত আইপিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরের পর থেকেই গাজার খাদ্য পরিস্থিতিতে বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে।

বর্তমানে সেখানে দুর্ভিক্ষ শুরু না হলেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে যে, ইসরায়েল এবং হামাসের দুই মাসের যুদ্ধবিরতিতে গাজায় সাময়িক স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে নতুন করে যে বৈরিতা দেখা যাচ্ছে, সেটা গাজাবাসীকে পুনরায় উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

Advertisement

বিশেষ করে গত মার্চের শুরু থেকে মানবিক সহায়তা প্রবেশে ইসরায়েলের অব্যাহত বাধা পরিস্থিতিতে আরও জটিল করে তুলেছে।

প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, বর্তমানে গাজার প্রায় দুই লাখ ৪৪ হাজার মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ অবস্থায় দুর্ভিক্ষের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আইপিসি।

গত মার্চের মধ্যভাগ থেকে গাজায় আবারও অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। এরপর গত দুই মাস ধরে সেখানে খাদ্য, ওষুধসহ জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।

ইসরায়েল বলছে, হামাসের হাতে এখনো যেসব নাগরিক জিম্মি রয়েছে তাদেরকে মুক্ত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই তারা এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যদিও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল ইসরায়েলের এই অব্যাহত অবরোধের বিরোধিতা করে নিন্দা জানিয়েছে।

Advertisement

জাতিসংঘ বলছে, গাজা সীমান্তে তারা এরইমধ্যে মানবিক সহায়তা সামগ্রী প্রস্তুত রেখেছে। ইসরায়েল বাধা না দিলেই সেগুলো দ্রুত ঢুকে যেতে পারবে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ত্রাণ সহায়তার ওপর ইসরায়েলের অব্যাহত এই অবরোধ এবং গাজাবাসীকে ‘অনাহারে রাখার নীতি’ যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। আইপিসি প্রকাশিত সবশেষ মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, গাজার প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন, অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ অনাহারের মুখোমুখি হচ্ছেন।

২০২৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১১ মাসে সেখানকার পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৭১ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মূল্যায়ন বিষয়ক সংস্থা।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্যাভাবের কারণে গাজার অনেক পরিবার বিভিন্ন ধরনের ‘চরম পদক্ষেপও’ নিচ্ছে। কেউ কেউ ভিক্ষা করা শুরু করেছে, অনেকে ময়লা-আবর্জনা কুড়িয়ে সেগুলো বিক্রি করে খাবার সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে।

আইপিসি জানিয়েছে, অক্টোবরের তুলনায় পরিস্থিতির এই অবনতি বিশ্বব্যাপী সংঘাতে ঘেরা অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটের প্রতিফলন। এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, প্রায় ১ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন (১৯ লাখ ৫০ হাজার) মানুষ অথবা গাজার জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চ স্তরের মধ্য দিয়ে বাস করছে। এর মধ্যে দুই লাখ ৪৪ হাজার মানুষ বিপর্যয়কর স্তরের সম্মুখীন হচ্ছে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অবশ্য গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার বিষয়টি মানতে নারাজ। তারা দাবি করেছে, যুদ্ধবিরতির সময় সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণ সামগ্রী প্রবেশ করেছে।

এদিকে হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে- গাজায় খাবার, ওষুধসহ অন্যান্য মানবিক সহায়তা যেন ঢুকতে দেওয়া হয় সেজন্য তারা ইসরায়েলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। সোমবার এডেন আলেক্সান্ডার নামে আমেরিকান-ইসরায়েলি নাগরিক এক জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস।

তাকে গাজায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রসের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রায় ৫৮০ দিন হামাসের হাতে জিম্মি থাকার পর নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গেছেন আলেক্সান্ডার।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আলেক্সান্ডারের মুক্তির পরিবর্তে তারা কেবল একটি নিরাপদ করিডোর দেওয়ার কথা ভাবছে বলেও জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে সফরে যাচ্ছেন। ট্রাম্পের এই সফরে কোনো চুক্তিতে না পৌঁছালে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের বর্ধিত আক্রমণ পরিকল্পনার মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজার সব এলাকা দখল করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া গাজাবাসীকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে দক্ষিণে পাঠানোর পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নেবে ইসরায়েল।

যদিও জাতিসংঘ সহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে যে, এটি বাস্তবায়ন হলে মানবিক সহায়তা সামগ্রীকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ইসরায়েল।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলায় প্রায় ১২০০ জন নিহত হয়। এছাড়া ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি করে হামাস। গত দেড় বছরে জিম্মি ইসরায়েলি নাগরিকদের অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন। তবে এখনো প্রায় ৫৯ জন জিম্মি হামাসের হাতে বন্দি রয়েছেন বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২৪ জনের মতো জীবিত রয়েছেন।

আরও পড়ুন: গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও এক সাংবাদিক নিহত গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত আরও ৪৪ গাজা থেকে ইসরায়েলে কয়েক দফা রকেট হামলা

অপরদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এখন পর্যন্ত ৫২ হাজার ৮৬২ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৮ জন আহত হয়েছেন। তবে সরকারি মিডিয়া অফিস মৃতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি বলে জানিয়েছে। কারণ নিখোঁজ হওয়া হাজার হাজার মানুষকে এখন নিহতের তালিকায় রাখা হয়েছে।

টিটিএন