শ্বশুর আন্তোনিও বার্সেলো ৭৯ বছর বয়সে এক কঠিন জীবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছিলেন। তিনি বাবা ছিলেন, স্বামী ছিলেন, নানা ছিলেন—আর শেষ সময়ে ছিলেন একজন অসুস্থ, ভীষণ দুর্বল মানুষ, যিনি একাধিক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন স্টকহোমের সেন্ট জর্জান হাসপাতালের হৃদ্রোগ বিভাগে।
Advertisement
আন্তোনিওর শরীরে দীর্ঘদিন ধরেই একসঙ্গে বাসা বেঁধেছিল বেশ কয়েকটি কঠিন রোগ: • হৃদ্যন্ত্রে পেস-মেকার • ডায়াবেটিস • অতিরিক্ত ওজন (মোটা) • হৃদ্রোগ (হার্ট ফেইলিউর) • কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস (রেনাল ফেলিওর)
এই জটিলতা তাকে করে তুলেছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের একজন। বার্ধক্য ও এই রোগগুলোর সংমিশ্রণে তার শরীর ক্রমাগত ভেঙে পড়ছিল।
কেন এত ভয়াবহ?৭৯ বছর বয়সী এক দেহ সহজে সেরে ওঠে না, বিশেষ করে পানি-লবণের ভারসাম্য বা সংক্রমণের মতো জটিলতায়। ডায়াবেটিস কিডনি ও হৃদ্যন্ত্রকে আরও দুর্বল করে, ফুসফুসের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে মোটা শরীর। আর যখন হার্ট ও কিডনি উভয়ই দুর্বল হয়, তখন এক অশুভ চক্র শুরু হয়—যেখানে পানি জমে শরীরে, নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়, হৃদ্পিণ্ড আরও দুর্বল হয়। এই ধরনের রোগীদের মধ্যে এক বছরের মধ্যে মৃত্যুর হার ৪০–৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
Advertisement
মুখ শুকিয়ে যাওয়া—একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেতচিকিৎসার এক পর্যায়ে আন্তোনিওর মুখ একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিল। এই ছোট বিষয়টি ছিল আসলে গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। এর পেছনে ছিল— • পানির পরিমাণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ • কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া • ইউরেমিয়া (রক্তে বিষাক্ত পদার্থ জমে যাওয়া) • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
মুখের শুষ্কতা থেকে তৈরি হয় বিভ্রান্তি, বমি ভাব, অসহ্য দুর্বলতা। শরীর যখন আর সামলাতে পারে না, তখন এই সামান্য লক্ষণগুলো হয়ে ওঠে জীবন-মৃত্যুর পূর্বাভাস।
যখন চিকিৎসা থেমে যায়…চিকিৎসকেরা একপর্যায়ে জানিয়ে দিলেন—আন্তোনিওর শরীর আর কোনও আগ্রাসী চিকিৎসা নিতে পারবে না। হয়ত তার দেহ এখন আর সহ্য করতে পারবে না নতুন চিকিৎসা, কিংবা এসব চিকিৎসার সম্ভাব্য ক্ষতি এর উপকারকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।
এমন সিদ্ধান্ত কয়েকটি জিনিস নির্দেশ করে:১. চিকিৎসার দৃষ্টিভঙ্গি এখন প্রশমনে (palliative care)। লক্ষ্য এখন যন্ত্রণানাশ, শ্বাসকষ্ট, উদ্বেগ আর মুখের শুষ্কতা প্রশমিত করা—জীবন টেনে দীর্ঘ করার জন্য নয়।২. কিছু চিকিৎসা ক্ষতিকরও হতে পারে। যেমন ডায়ালাইসিস বা শক্তিশালী ওষুধ—যা দুর্বল দেহে আরও ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।৩. রোগীর ইচ্ছাকেও সম্মান দেওয়া হয়। সম্ভবত আন্তোনিও নিজেই বলেছিলেন—আর নয়, এবার শুধু শান্তি চাই।
Advertisement
আমাদের, প্রিয়জনদের করণীয় কী?এই অসহায়তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কিন্তু কিছু জিনিস আছে, যা আমাদের হাতেই—১. উপস্থিতি। একটি উষ্ণ হাত, একটুখানি ছবি, চেনা কণ্ঠ—এগুলো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অমূল্য।২. প্রশ্ন করা। চিকিৎসা কোন পর্যায়ে? প্রশমনের বাইরে কিছু কি আর করা সম্ভব নয়? আর কত সময় আছে আমাদের হাতে?৩. পরস্পরের পাশে থাকা। একজনের কাঁধে ভর দিয়ে আরেকজন এগোতে পারে। হয়ত কাউন্সেলরের দরজায়ও কড়া নাড়তে হতে পারে।৪. সম্মান বজায় রাখা। মুখের পরিচর্যা, আরামদায়ক পরিবেশ, পছন্দের সংগীত—এ সবই জীবন শেষ হওয়ার আগের মুহূর্তগুলোকে অর্থবহ করে তোলে।
এক নিঃশব্দ সংগ্রাম, এক মর্যাদাপূর্ণ বিদায়আমরা চাই না আমাদের প্রিয়জন কষ্টে থাকুক। আমরা পাশে থাকতে চাই, বুঝতে চাই, জড়িয়ে ধরতে চাই শেষ মুহূর্তে। জীবন যদি আর রক্ষা করা না যায়, সম্মান অন্তত যেন রক্ষা পাই।
আমরা এই লেখা লিখছি তাদের জন্য—যারা এমন বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, কিংবা যাবে। এসব কথা সাধারণত বলা হয় না, অথচ বলা দরকার। প্রতিটি রোগাক্রান্ত শরীরের ভেতরে বাস করে একজন মানুষ। একজন বাবা, একজন জীবনযোদ্ধা, একজন প্রিয়জন। আর পাশে থাকি আমরা—জেগে থাকি, ভালোবাসি, বিদায় জানাই।
এপিলগ: আন্তোনিও বার্সেলো (১৯৪৬–২০২৫)স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া থেকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সুইডেনে আসেন আন্তোনিও। কেটিএইচ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে জীবনের অনেকটা সময় দিয়েছেন খাদ্যশিল্পে। স্ত্রী ছিলেন বিরগিত লিন্ড বার্সেলো, যিনি কোভিড-১৯-এ মারা যান ২০২০ সালে।আন্তোনিও বার্সেলো ৮ মে ২০২৫, দুপুর ২টায় স্টকহোমের ’St. Göran’ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
— রহমান মৃধাগবেষক এবং লেখকপূর্ব পরিচালক, ফাইজার, সুইডেনRahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/জেআইএম