পরিবর্তিত পরিস্থিতে দায়িত্ব নিয়ে চলতি বছর পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষাবর্ষের চার মাসের মাথায় এপ্রিলে সব বই বিতরণ শেষ হয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
Advertisement
বছর ঘুরতেই এবার পাঠ্যবইয়ের চাহিদা কমেছে ১০ কোটি। যেটা অনেকটা অস্বাভাবিক মনে হলেও কিছু যৌক্তিক কারণ তুলে ধরেছেন সংশ্লিষ্টরা। বছরের শুরুতেই এবার সবার হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন তারা।
মূলত পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে গত বছরের বাজে অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এবার আগেভাগে কাজ শুরু করেছে সরকার। নভেম্বরের মধ্যেই সব শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ শেষ করতে চায় এনসিটিবি। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। চলতি মাসে আরও কয়েকটি দরপত্র আহ্বান করা হবে।
আরও পড়ুন
Advertisement
এনসিটিবি সূত্র জানায়, চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের চেয়ে আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে ১০ কোটি বই কম ছাপা হবে। চলতি বছর ছাপা হয়েছিল প্রায় ৪০ কোটি ১৬ লাখ পাঠ্যবই। এবারের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা কমে ৩০ কোটি ৫২ লাখে নেমেছে। পাঠ্যবইয়ের এ চাহিদা যাচাই চলছে এবং তা আরও কমতে পারে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি।
পাঠ্যবই কমেছে, কোন শ্রেণিতে কত২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য সারাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ি মাদরাসার কাছে গত মার্চে পাঠ্যবইয়ের চাহিদা চেয়েছিল এনসিটিবি। প্রাথমিকভাবে মাধ্যমিকে ২১ কোটি ৯৮ লাখ এবং প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক মিলিয়ে আট কোটি ৯৪ লাখ ২৫ হাজার পাঠ্যবইয়ের চাহিদা পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া এ চাহিদা হাতে আসার পর তা যাচাই করছে সংস্থাটি।
এনসিটিবির দেওয়া তথ্যমতে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য আট কোটি ৯৪ লাখ ২৫ হাজার বই ছাপার চাহিদা পাওয়া গেছে। গত বছর প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকে পাঠ্যবই ছাপা হয়েছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার কপি। সে হিসাবে এবার প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক মিলিয়ে ২৫ লাখ ২৯ হাজার কপি পাঠ্যবই কম ছাপা হবে।
মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম ও ইবতেদায়ির জন্য ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে ২১ কোটি ৫৮ লাখ পাঠ্যবই ছাপার চাহিদা পেয়েছে এনসিটিবি। এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির চার কোটি ৪৩ লাখ ৭২ হাজার, চার কোটি ১৬ লাখ ৯৬ হাজার ৬৬১ কপি বই প্রয়োজন। এ দুটি শ্রেণির বইয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
Advertisement
অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের দরপত্র এখনো হয়নি। এ দুটি শ্রেণিতে যথাক্রমে চার কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার এবং পাঁচ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার ৩৭৯ কপি পাঠ্যবই ছাপার চাহিদা পেয়েছে এনসিটিবি।
এছাড়া কারিগরি দশম শ্রেণির জন্য ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৯৯৬ কপি এবং ইবতেদায়ির প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ৩ কোটি ২৩ লাখ ৩৬ হাজার কপি বই ছাপা হবে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া চাহিদার তথ্য আরও যাচাই-বাছাই চলছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।
আমাদের টার্গেট ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করবো। বই সব উপজেলা পর্যায়ে চলে যাবে। ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুলে স্কুলে বই পৌঁছানো হবে। জানুয়ারির ১ তারিখে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে দিয়ে দেবো। শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে সব বই নিয়ে ক্লাসে অংশ নেবে শিক্ষার্থীরা।- এনসিটিবি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্বে) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর আমরা যে চাহিদা পেয়েছিলাম, সেখানে কিছু কিছু জায়গায় অসংগতি ছিল। কেউ কেউ একটু বেশি চাহিদা দিয়েছিলেন। এবার যাতে তেমনটি না ঘটে, সেজন্য আমরা প্রাথমিকভাবে পাওয়া চাহিদার তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করছি। হয়তো চূড়ান্তপর্যায়ে গিয়ে বইয়ের সংখ্যাটা আরও একটু কমতে পারে।’
পাঠ্যবইয়ের চাহিদা কমেছে যে দুই কারণেচলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ছাপা হয়েছিল ৪০ কোটি ১৬ লাখ বই। এক বছরের ব্যবধানে হঠাৎ করেই প্রায় ১০ কোটি বইয়ের চাহিদা কমে গেছে। হঠাৎ এত সংখ্যক বইয়ের চাহিদা কমার পেছনে দুটি কারণ জানিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।
বইয়ের চাহিদা কমার কারণ প্রসঙ্গে এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কিছু অতিরিক্ত চাহিদা পাঠিয়েছিল অসাধু চক্র। এবার সেটা হতে দেওয়া হয়নি। আমরা এবার মাধ্যমিকের বইয়ের চাহিদা সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়েছি। এতে ছলচাতুরি তো কিছুটা কমেছে।’
‘আরেকটি কারণ হলো গত বছর আমাদের মাধ্যমিকের দশম শ্রেণির বই ছাপাতে হয়েছিল। কারণ হঠাৎ করেই নতুন কারিকুলাম বাতিল করে আগের শিক্ষাক্রমে ফেরার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে চার কোটির বেশি বই ছাপাতে হয়েছিল। এবার কিন্তু মাধ্যমিকের দশম শ্রেণির বই ছাপতে হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের সংখ্যাটা কমেছে।’ যোগ করেন অধ্যাপক ড. রিয়াদ।
গত বছর আমরা যে চাহিদা পেয়েছিলাম, সেখানে কিছু কিছু জায়গায় অসংগতি ছিল। কেউ কেউ একটু বেশি চাহিদা দিয়েছিলেন। এবার যাতে তেমনটি না ঘটে, সেজন্য আমরা প্রাথমিকভাবে পাওয়া চাহিদার তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করছি। হয়তো চূড়ান্তপর্যায়ে গিয়ে বইয়ের সংখ্যাটা আরও একটু কমতে পারে।- এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী
এদিকে, প্রাথমিকেও এবার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ কমেছে। প্রাথমিকের বই ছাপা-বিতরণ তদারকি করে এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ শাখা। কারণ জানতে চাইলে প্রাথমিকের উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতবছর আমরা ৯ কোটি ১৯ লাখের কিছু বেশি বই ছাপিয়েছিলাম। এবার আমাদের কাছে বইয়ের চাহিদা ২৫ লাখের মতো কম এসেছে। শিক্ষার্থী কমেছে নাকি অন্য কোনো কারণে এটা হয়েছে তা আমি বলতে পারবো না। কারণ প্রাথমিকের বইয়ের চাহিদাটা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে নেওয়া হয়। তারাই আমাদের এটা জানান।’
নভেম্বরের মধ্যেই ছাপা-বিতরণ শেষ করার টার্গেটপাঠ্যবই ছাপার পর বিতরণেও অনেক সময় লেগে যায়। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বই পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়। ফলে এবার আগেভাগে বই ছাপা ও উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর কাজ শেষ করতে চায় এনসিটিবি। সেজন্য একটি রোডম্যাপও প্রণয়ন করেছেন তারা।
রোডম্যাপ অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের পাঠ্যবই ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ছাপা শেষ করে দেশের সব উপজেলায় পৌঁছে দেওয়া হবে। আর মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ি শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপা ও উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো শেষ করা হবে ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই। উপজেলা থেকে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখের মধ্যেই সব স্কুলে স্কুলে বই চলে যাবে। বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেওয়া হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্বে) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বছর দেরিতে বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। গত বছর আমরা দেরিতে কাজ শুরু করেছিলাম, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব ছিল, আবার কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। এবার সে ধরনের পরিস্থিতি হওয়ার সুযোগ নেই।’
বই ছাপা ও বিতরণ শেষ নিয়ে এনসিটিবির টার্গেট নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের টার্গেট ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করবো। বই সব উপজেলা পর্যায়ে চলে যাবে। ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুলে স্কুলে বই পৌঁছানো হবে। জানুয়ারির ১ তারিখে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে দিয়ে দেবো। শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে সব বই নিয়ে ক্লাসে অংশ নেবে শিক্ষার্থীরা।’
এএএইচ/এএসএ/এমএস