আজকের দ্রুতগতির জীবনযাত্রায় কর্মজীবী বাবা-মায়ের জন্য সন্তানের যত্ন এবং সেই সঙ্গে পেশাগত জীবন পরিচালনা করা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন পূর্বপরিচয় ও কোন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় না থাকা একজন অপরিচিত গৃহকর্মীর কাছে সন্তানকে রেখে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন ও সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ।
Advertisement
তাই যখন বাবা-মা উভয়েই বাড়ির বাইরে কর্মরত থাকেন, তখন সন্তানদের সঠিক যত্ন নেওয়ার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। এমন পরিস্থিতিতে ডে-কেয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। তবে সেখনেও কী আপনার শিশু সম্পূর্ণ নিরাপদ? ডে-কেয়ার সেন্টারে সন্তানে রাখার সুবিধা যেমন আছে, তেমনি ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জও আছে। তাই আপনার শিশুকে ডে-কেয়ারে রাখার অঅগে অবশ্যই দুটি দিকই ভালো করে বুঝে নিন-
সুবিধা:
১. প্রথমত, ডে-কেয়ারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো পেশাগত স্থিতিশীলতা। কর্মজীবী বাবা-মায়ের জন্য এটি একটি বড় সহায়ক। যখন সন্তানকে একটি নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী সুরক্ষিত এবং যত্নশীল পরিবেশে রাখা যায়, তখন অভিভাবকরা নিজেদের পেশাগত জীবনে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন। এতে তাদের কর্মক্ষমতা ও কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
Advertisement
২. ডে-কেয়ার সেন্টার শিশুদের সামাজিক বিকাশেও ভূমিকা রাখে। শিশু অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা, কথাবার্তা ও বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়ে সামাজিক দক্ষতা অর্জন করে। এতে আত্মবিশ্বাস ও সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৩. আরেকটি সুবিধা হলো শিক্ষামূলক কার্যক্রম। বেশিরভাগ ডে-কেয়ার সেন্টারে শিশুদের গান, নাচ, আঁকা কিংবা গল্প বলার মাধ্যমে শেখানো হয়। এসব কার্যক্রম শিশুর সৃজনশীলতা ও বুদ্ধির বিকাশে সহায়ক। ডে কেয়ার সেন্টারে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ তাদের পরবর্তী স্কুলজীবনের জন্য প্রস্তুত করে।
৪. এছাড়া, নিয়মিত রুটিনে চলার ফলে শিশুরা শৃঙ্খলা ও আত্মনির্ভরতা শেখে। সময় ব্যবস্থাপনা ও নিজ দায়িত্ব পালনের অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে।
তবে সব সুবিধার পাশাপাশি ডে-কেয়ার ব্যবস্থার কিছু অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
Advertisement
১. প্রথমত, একাধিক শিশু একত্রে অবস্থান করার ফলে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সর্দি-কাশি, জ্বর বা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২. দ্বিতীয়ত, মানসিক চাপ। অনেক অভিভাবক সন্তানকে দীর্ঘ সময় দূরে রেখে তার খাওয়া-দাওয়া বা মনের অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। এটি তাদের কাজের মনোযোগে প্রভাব ফেলতে পারে।
৩. তৃতীয়ত, দীর্ঘ সময় ডে-কেয়ার সেন্টারে থাকলে শিশুদের আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। তারা মেজাজি বা অস্থির হয়ে পড়তে পারে, বাবা-মায়ের সঙ্গে সংযুক্তির অভাবও তৈরি হতে পারে। তাছাড়া, গুণগতমানসম্পন্ন ডে-কেয়ার সেন্টারের খরচ অনেক সময় সাধারণ পরিবারের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
৪. এছাড়াও ডে-কেয়ারের সময়সূচী সব সময় কর্মজীবী বাবা-মায়ের কাজের সময়ের সঙ্গে মেলে না, ফলে আরও সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। আবার, মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের সচেতন থাকা প্রয়োজন, যেমন- লাইসেন্সিং, কর্মীদের প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি।
৫. বর্তমানে অনেক ডে-কেয়ার সেন্টারে শিক্ষামূলক অ্যাপস, ট্যাবলেট বা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এটি শিক্ষায় সহায়ক হতে পারে, তবে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি।
বাংলাদেশ সরকার ‘জাতীয় শিশু দিবাযত্ন নীতিমালা ২০২১’ প্রণয়ন করেছে। কর্মজীবী নারীদের কর্মক্ষেত্রে রাখার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার চালুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যাংক, বেসরকারি সংস্থা এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ইতিমধ্যে এই সুবিধা চালু করেছে।
তবে এই উদ্যোগ এখনও সীমিত। নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং শিশুদের নিরাপদ বিকাশ নিশ্চিত করতে ডে-কেয়ার ব্যবস্থার প্রসার ও মান নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
ইউনিসেফের ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার বাড়লেও এখনও ৩-৫ বছর বয়সী শিশুর একটি বড় অংশ এই সেবার বাইরে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিকল্পিত ডে-কেয়ার ব্যবস্থায় বড় হওয়া শিশুদের ভাষাগত দক্ষতা ও সামাজিকতা উন্নত হয়।
ঢাকার একটি ব্যস্ত প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন শিরিন আক্তার। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন সকাল ৮টার দিকে অফিসের উদ্দেশ্য বের হই। সন্তানকে মহল্লার ডে-কেয়ারে রেখে আসার পর মানসিকভাবে অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকি। তবে একটানা দূরে থাকায় আবেগের একধরনের ফাঁক তৈরি হয়, সেটি কষ্ট দেয়।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে শিশুদের নিরাপদ পরিচর্যা ও বিকাশের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছে 'কিডি কেয়ার'। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক লুৎফুন নাহার মলি জানান, আমাদের এখানে শিশুদের খেলা, শেখা ও বেড়ে ওঠার জন্য রয়েছে শিশুদের উপযোগী পরিবেশ। অভিজ্ঞ ও যত্নশীল কেয়ার গিভারদের মাধ্যমে বাচ্চাদের সর্বোচ্চ যত্নে লালন-পালন করা হয়।
সব অভিভাবকের জন্য ডে-কেয়ার হয়তো কার্যকর নয়। অনেক পরিবার পরিচিত আত্মীয় বা পারিবারিক কেয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুর দেখভালের ব্যবস্থা করে থাকেন। এছাড়া, হাইব্রিড ওয়ার্ক মডেল, ফ্লেক্সিবল অফিস আওয়ার এবং প্রতিবেশীভিত্তিক কমিউনিটি কেয়ার ব্যবস্থা একটি টেকসই বিকল্প হতে পারে।
ডে-কেয়ার ব্যবস্থা কর্মজীবী বাবা-মায়ের জন্য নিঃসন্দেহে একটি সহায়ক উপায়। তবে এর সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন থেকে এবং মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করে সন্তানের উন্নয়ন ও পেশাগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব।
সূত্র: জাতীয় শিশু দিবাযত্ন নীতিমালা ২০২১, ইউনিসেফ বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ
এএমপি/এএসএম