বাংলাদেশের শিল্পায়নের বর্তমান চিত্রে যে নীরব বিপ্লব ঘটছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইপিজেডসমূহ। সরকারি নীতির রূপান্তর এবং এই রূপান্তরে ইপিজেডের কৌশলগত সংযুক্তি আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উৎপাদন খাতের শক্তিশালী ভিত্তি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য শিল্পায়ন কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাহন নয়, বরং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে শিল্প নীতিতে যে মৌলিক রূপান্তর এসেছে, তাকে অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ ‘প্যারাডাইম শিফট’ হিসেবে অভিহিত করেন।
Advertisement
এই রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ইপিজেডসমূহ (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা) একটি কার্যকর ও কৌশলগত মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যা দেশের শিল্পখাতের গতিপথই বদলে দিতে অবদান রেখেছে। শিল্প নীতির প্যারাডাইম শিফট বলতে বোঝায় একটি মৌলিক পরিবর্তন, যা কেবল নীতিমালার ভাষাগত রূপ নয়, বরং কাঠামো, বাস্তবায়ন কৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈপ্লবিক রূপান্তর। অতীতের আমদানি বিকল্প শিল্পনীতি আজ রপ্তানিমুখী, প্রতিযোগিতামূলক এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পনীতিতে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতির মুক্ত বাজারনীতি, উৎপাদনশীল বিনিয়োগ, এবং প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের প্রসার। বাংলাদেশও ২০১৬ সালের শিল্পনীতি এবং পরবর্তী কৌশলগত পরিকল্পনাগুলোর মাধ্যমে শিল্পায়নকে রপ্তানিমুখী ও কর্মসংস্থানমুখী করার পথ ধরে এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের ইপিজেড ব্যবস্থার সূচনা হয় সাবেক বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট রবার্ট এস. ম্যাকনামারার ১৯৭৮ সালের এক প্রস্তাবনার মাধ্যমে।তিনি ঐসময়ে বাংলাদেশ সফরকালে ইপিজেড গঠনের পরামর্শ দেন। উদ্দেশ্য ছিল যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কর ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া শিল্প স্থাপন করতে পারবে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে ‘বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ’ (বেপজা) আইন প্রণয়ন করা হয় এবং ১৯৮১ সালের ১৫ এপ্রিল বেপজা তার কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠার দুই বছরেরও কম সময়ে ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেড চালু করা হয়।
শিল্পখাতের আধুনিকায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি ত্বরান্বিত করা এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় জায়গা করে নেওয়ার লক্ষ্যে বেপজাকে আরও সক্রিয় ও কৌশলগত ভূমিকায় অবতীর্ণ করা চিন্তা করা যেতে পারে। বর্তমানে ইপিজেড কেবল একটি শিল্প এলাকা নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের একটি কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
Advertisement
এরপর থেকে দেশের আটটি ইপিজেড ও একটি ইকোনমিক জোন (ইজেড) বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণ, রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে চলেছে। বিনিয়োগবান্ধব অবকাঠামো, কর রেয়াত, শুল্ক সুবিধা, ও ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করে ইপিজেডসমূহ দেশে ও বিদেশে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে করোনা মহামারির ব্যতিক্রমকালীন সময় বাদ দিলে, বেপজা পরিচালিত ইপিজেডসমূহে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি-উভয় ক্ষেত্রেই ধারাবাহিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ইপিজেডসমূহে পরিচালন দক্ষতা, পরিবেশগত মান এবং বিনিয়োগ-সহায়ক নীতির কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক স্থায়ী আস্থা গড়ে উঠেছে।
পাশাপাশি, প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ইপিজেডগুলোর ধারাবাহিক চাহিদা বেপজার সেবার মান ও পেশাদারিত্বের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থারই প্রতিফলন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিল্প খাতের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী ছিল।। ১৯৭২ সালের ‘Industrial Policy Order’-এ মৌলিক শিল্প জাতীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এসময় ‘Commanding heights’ ধারণার আলোকে রাষ্ট্রই শিল্প উন্নয়নের প্রধান চালকের আসনে ছিল। তবে আশির দশক থেকে এই নীতিতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে। ইপিজেড প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিল্পায়নে বেসরকারি অংশগ্রহণ, বিদেশি বিনিয়োগ, রপ্তানিমুখী উৎপাদন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর জোরদার হয়।
শিল্পনীতিতে এই রূপান্তরের ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক শিল্পচক্রে (Global Industrial Cycle) যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। ইপিজেডসমূহ আজ টেকসই শিল্পায়ন ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে। ইপিজেডসমূহে কয়েকটি পোশাক কারখানায় (LEED সনদপ্রাপ্ত) সোলার প্যানেল, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবননির্ভর শিল্পায়নের ধারা অনুসরণ করে ইপিজেডে ইলেকট্রনিক্স, মেডিকেল ডিভাইস ও কসমেট্রিক্স খাতের উৎপাদনও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান ইপিজেড সমূহে ৫২ ভাগ তৈরি পোশাক এবং ৪৮ ভাগ অন্যান্য সামগ্রী উৎপাদন হচ্ছে, যা রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণে ইপিজেডের ভূমিকার একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত। এর পাশাপাশিই পিজেডে নারী শ্রমিকদের উল্লেখ্য অংশগ্রহণ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়। বর্তমানে ইপিজেড শ্রমিকদের প্রায় ৬৫ শতাংশই নারী, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষভাবে নীলফামারীতে প্রতিষ্ঠিত উত্তরা ইপিজেডে নারীরা শুধু শ্রমিক হিসেবেই নয়, নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি ও নারী নেতৃত্বের এগিয়ে আসার পরিচায়ক।
একসময়ের গার্মেন্টস-নির্ভর ইপিজেড এখন খাত ও বাজার বৈচিত্র্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিরাপদ, নিয়ন্ত্রিত কর্মপরিবেশ ইপিজেডের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা শ্রম অসন্তোষ খুবই কম। ফলে উৎপাদন ব্যাহত না হয়ে রপ্তানি স্থিরভাবে বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
Advertisement
বর্তমানে বাংলাদেশে বেপজার অধীনে রয়েছে ৮টি ইপিজেড এবং ১টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেপজা ইজেড, মিরসরাই)। এসব অঞ্চলে ৪৫০ টির বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে এবং প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে এসব অঞ্চল থেকে দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১.৫৩ শতাংশ, মোট রপ্তানির ২০ শতাংশ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ২৫ শতাংশ অর্জিত হয়। পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে, ইপিজেড কেবল শিল্পায়নের বাহন নয়, বরং রপ্তানি বৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি।
ইপিজেড থেকে উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়ে দেশের আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করছে। এছাড়া, এই অঞ্চলগুলোর প্রভাবে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন সম্ভব হয়েছে। ইপিজেডের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শিল্পায়নের বিকেন্দ্রীকরণ, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজধানী-কেন্দ্রিক শিল্পনীতির বাইরে গিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক গতিশীলতা সৃষ্টি করেছে এবং আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
সব অর্জনের পরও ইপিজেডসমূহের সামনে এখনো কিছু কাঠামোগত ও নীতিগত চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে,যেমন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি, আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার ঘাটতি, আধুনিক অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, প্রশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগের অভাব এবং আন্তঃদপ্তরীয় সমন্বয়ের জটিলতা। এসব বাধা দূর করতে হলে প্রয়োজন সুসমন্বিত ও গবেষণাভিত্তিক শিল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা, আধুনিক কারিগরি ও প্রযুক্তিভিত্তিক মানবসম্পদ উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক নীতিনির্ধারণ। তবে পরিসংখ্যানগত তথ্য এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশের শিল্পায়নের আধুনিক রূপান্তরে বেপজার ইপিজেডসমূহ একটি কার্যকর, কৌশলগত ও বাস্তবমুখী মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বৈদেশিক বিনিয়োগ, উৎপাদনশীলতা, নারীর অংশগ্রহণ এবং প্রযুক্তিনির্ভরতার মাধ্যমে এই মডেল দেশের অর্থনীতিকে একটি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সহায়ক হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ মনে করেন, আগামী দিনের শিল্পনীতি ও বিনিয়োগ পরিকল্পনায় ইপিজেড মডেল অনুসরণযোগ্য ও বাস্তবভিত্তিক একটি কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
শিল্পখাতের আধুনিকায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি ত্বরান্বিত করা এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় জায়গা করে নেওয়ার লক্ষ্যে বেপজাকে আরও সক্রিয় ও কৌশলগত ভূমিকায় অবতীর্ণ করা চিন্তা করা যেতে পারে। বর্তমানে ইপিজেড কেবল একটি শিল্প এলাকা নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের একটি কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। দেশের শিল্প নীতিকে যুগোপযোগী করে তুলতে হলে বেপজাকে কেবল অবকাঠামোগত নয়, নীতিনির্ধারণী স্তরেও আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। ইপিজেড এখন আর শুধু শিল্প অঞ্চল নয়, এটি রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধির কৌশলগত চালিকাশক্তি।
লেখক: উপপরিচালক, বেপজা।
এইচআর/এএসএম