মতামত

নারীর স্বাধিকার ও সমাজের বিবিধ প্রতিরোধ

নারীর স্বাধিকার ও সমাজের বিবিধ প্রতিরোধ

“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছেআমরা তখনো বসে,বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছিফিকাহ ও হাদীস চষে”

Advertisement

বহু আগে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কবিতার চিত্রটি এখনো বিদ্যমান। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, নাকি শতবর্ষ পিছিয়ে যাচ্ছে আবার নতুন করে! নাসার মহাকাশচারী নারী সুনিতা উইলিয়াম যখন মহাকাশ জয় করে পৃথিবীতে ফিরলো তখন আমাদের দেশে ফতোয়া জারি হলো, নারীগণ মাহারাম ছাড়া একা বাড়ির বাইরে যেতে পারবেনা। আকাশ সমান এই মূর্খতার সীমা নেই।

নারী অধিকারের কথা উঠলেই বাংলাদেশে একদল বক ধার্মিক হই হই করে উল্লম্ফন করতে থাকে। নারী কি করবে, কোন ধরনের পোশাক পরবে কিংবা সমাজ পরিবর্তনে তার ভূমিকা কী—তার সব কিছুই নির্ধারণ করার দায়িত্ব নিয়ে যেন তারা বসে থাকে। আর কোনো কাজ তাদের নেই। একজন অশিক্ষিত অযোগ্য পথচারীও হয়ে উঠে নারীর অভিভাবক। এমনকি দশ বারো বছর বয়সী কোনো বালকও নারীর সমালোচনায় মুখর হতে পারে, কারণ সেই অধিকার তাকে দেওয়া হয়ে গেছে। ধর্মীয় ফতোয়া ও কুসংস্কার নারীদেরকে অন্ধকারে রাখতে চায়। টেনে পিছিয়ে দিতে অপতৎপরতা চালায়। নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ তাদের চোখে ভয়াবহ ও আপত্তিজনক।

বাংলাদেশ সব ধর্মের, সকল মতের মানুষের একটি দেশ। এখানে উগ্র ধর্মান্ধতার স্থান কখনো ছিল না। আগামীতেও থাকবে না। একদল নারী আছে, তারা আরো এককাঠি এগিয়ে থাকে। এমন সবিরোধী কর্মকাণ্ড করার মত মানসিকতা খুবই ভয়ংকর! মাত্র কয়েকদিন আগে দেখলাম আগাগোড়া কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত হয়ে কতিপয় নারী বিবৃতি দিচ্ছে, নারীদের কাজ ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না। সন্তান জন্মদান, সন্তানের লালন পালন এবং স্বামীর মনোরঞ্জন ও তার সন্তুষ্টি রক্ষা করাই নারীর একমাত্র কাজ। এই সকল বিবৃতি সরাসরি অন্য নারীদের জন্য অবমাননাকর। এটা চরম ধরনের ধৃষ্টতা।

Advertisement

পুরুষের সামনে সাকির মত সুরা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আরব্য রজনীর দেশ এই বাংলাদেশ নয়। রাজু ভাস্কর্যের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে আসমানে উড়তে চাওয়া নারীর প্রতিচ্ছবিই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এবং এটিই অমোঘ এবং শেষ উচ্চারণ।

দিন দিন এই ধরনের মানসিকতার নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশকে অন্ধকারে দিকে ঠেলে দিতে পারে। এর জন্য তাদের সুশিক্ষার অভাব, পারিবারিক চাপ, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মান্ধতা দায়ী। এই নারীরা অন্য নারীদেরকে সর্বদা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে। সুযোগ পেলে যখন তখন হেনস্তা করে। এরা আসলে নিজেকে নিয়ে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। যখন একটি স্বাধীন নারী নিজেকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যায়, যখন নারী শিক্ষা, সংস্কৃতি অনেক দূর অগ্রসর হয়, নিজের পছন্দের পোশাক নির্বাচন করে তখন কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত নারীরা সেটা সহ্য করতে পারেনা। তাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে অন্য নারীদেরকে—যারা তাদের থেকে এগিয়ে গেলো—তাদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণের মাধ্যমে। এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে, কুসংস্কার ও অন্ধত্ব দূর করতে পারলে, তবেই নারীর এগিয়ে যাওয়াটা মসৃণ হবে।

আমরা সবসময় জেনেছি, বলেছি— নারী কোন পোশাক পরবে, কীভাবে চলবে সেটা তার ব্যক্তিগত চয়েস। যারা হিজাব, নিকাব বা বোরকা পরছেন তাদেরকে অত্যন্ত সমীহ করা হয়েছে কারণ এটা তার ব্যক্তিগত পছন্দ। কিন্তু এই সমীহ করা যেন প্রগতিশীল, শিক্ষিত নারীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে! আস্কারা পেয়ে তারা এখন মাথার উপর চেপে বসতে চাইছে। লাঠি উঁচিয়ে অন্যদেরকে শায়েস্তা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এরা পারলে নারীদেরকে একঘরে করে রাখে। আর শিক্ষিত নারীরা নিজেকে সংখ্যালঘু ভাবতে বাধ্য হওয়ার মত এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে দিন কাটায়। এ যেন নিজ ভূমে পরবাস!

কবিগুরুর ভাষায়, “আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে।” আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা বাঙালি। আবহমান কাল ধরে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে বুকে লালন করে আসছি। আমাদের চলনে বলনে এর ছাপ থাকবে সুস্পষ্ট। বাংলার প্রাচীন কালেই শাড়ি ছিল নারীদের প্রধান পোষাক। এর সাথে থাকতো না কোনোপেটিকোট কিংবা ব্লাউজ। একটা বিশেষ কায়দায় নারীরা এই পোশাক পরে অভ্যস্ত ছিলেন। এই পোশাক পরেই আমাদের পূর্ব নারীগণ ঘরে এবং বাইরে দিনযাপন করতো। তারা ক্ষেতে খামারে কাজ করতো। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আয়-রোজগারও করতো।

Advertisement

সময়ের সাথে সাথে সমাজের প্রতিটি পারিপার্শ্বিক কাঠামোতেই আসে পরিবর্তন। নারীরা শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে গেছে বহুদূর। তারা তাদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন করে থাকে। “চলাই জীবন, থেমে যাওয়ার নাম মরণ”— এই উক্তিকে মাথায় রেখে বেশির ভাগেরাই বৈশ্বিক চলমানতার সাথে নিজেকে পরিবর্তন করেছে। এই ক্ষেত্রে নারীর পোশাকেও এসেছে ধারাবাহিক পরিবর্তন। স্বচ্ছন্দে চলাফেরার জন্য পাশ্চাত্য ধাঁচের পোশাকও নির্বাচন করে থাকে। এবং এই চলমানতা থাকবেই। একদিকে যখন নারীরা শিক্ষা, ক্যারিয়ার ও স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কিছু ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এর বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

দেশের নারীরা এখন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। কাজ করছে ঘরে-বাইরে, যে যার দক্ষতা অনুযায়ী। আর এই সময়ে কিনা কিছু নারী এসে দাবি করছে, “নারীর কাজ কেবল স্বামীর মনোরঞ্জনে সীমাবদ্ধ!“ আপাদমস্তক আচ্ছাদিত আরবীয় সংস্কৃতির কালো পোশাক যদি হয় আপনার পছন্দ তা আপনি পরুন না! কিন্তু সেই একই জিনিস অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চাওয়ার দাবিটা অন্যায়, এই দাবি অসভ্যতা, অন্যায্য- এটা আপনাকে বুঝতে হবে!

নারী প্রশ্নে বাংলাদেশে এই পারিপার্শ্বিক চাপ সবসময়ই ছিল। কিন্তু ইদানীং বহুলাংশে এই সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক মাসের কিছু খণ্ডচিত্র সমাজের জন্য খুবই ভয়াবহ এক সময়ের ইঙ্গিত বহন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে “ওড়না কেনো ঠিক করে পরা হলো না” সেই অজুহাতে চরম হেনস্তা করা হলো। কিছু অন্ধ মৌলবাদী উল্লম্ফন করে উত্ত্যক্ত্যকারী পুরুষটির পক্ষ নিলো। ফুলের মালা পরিয়ে তাকে আরো দুষ্কর্ম করার জন্য আস্কারা দেওয়া হলো। দু’হাজার পঁচিশে এসে এই ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক।

আজকাল রাস্তা-ঘাটে, বাসে, মেট্রোতে কিছু নারী ওত পেতে থাকে অন্য নারীকে পোশাকের বিষয়ে হেনস্তা করার জন্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশ এখন মৌলবাদী নারী-পুরুষের দখলে। দেশটাকে তারা পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায় সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময়ে, যখন কারো ঘরে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে জীবন্ত দাফন করা হতো। যখন নারীরা ছিল শুধু ভোগ্যপণ্য! আজ ঠিক সেই সুরে সুর মিলিয়ে বলা হচ্ছে, নারীর জীবনের উদ্দেশ্য স্বামীর ভোগ্য হওয়া।

কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কখনো এই অবস্থা মেনে নেয়নি। নেবে না। প্রতিটি শিক্ষিত নারী পুরুষ এই অবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান করে। একটা বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত, অন্ধ প্রগতি বিরোধী না হয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এই জনগোষ্ঠীকে। বহির্বিশ্বে তাকিয়ে দেখুন, যেই দেশ শিক্ষায় যত বেশি এগিয়ে সেই দেশই কিন্তু বিশ্বে রাজত্ব করছে। তারাই বৈশ্বিক কাঠামোর নীতি নির্ধারণ করছে। তাদের আবিষ্কৃত টুলসগুলোই কিন্তু নির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করছে। এমনকি ধর্মীয়ভাবে এগিয়ে যেতে হলেও সুশিক্ষা গ্রহণ খুবই প্রয়োজন। ইতিহাস সাক্ষী, যারা সময়ের পরিবর্তনশীলতা গ্রহণ করেছে, তারা উন্নতি করেছে। কেবল গায়ের জোরে কিংবা গলার জোরে কোনো জাতি কখনো সফল হতে পারেনি। বরং তারা তিরস্কৃত হয়েছে।

আপনাদের মত অন্ধ ধর্মীয় ব্যক্তিদের জন্য বহির্বিশ্বের কাছে আমরা “সন্ত্রাসবাদী” বলে পরিচিত হয়েছি। এর প্রধান সমাধান যুগোপযোগী শিক্ষাগ্রহণ করা। এর কোনো বিকল্প নেই। না পুরুষের জন্য, না নারীর জন্য। শেষ পর্যন্ত, নারীর স্বাধিকার নিশ্চিত না হলে দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। সমাজে সৌন্দর্য ও শক্তি তখনই বিকশিত হবে, যখন সবাই একসঙ্গে ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধত্ব এড়িয়ে, সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে।পুরুষের সামনে সাকির মত সুরা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আরব্য রজনীর দেশ এই বাংলাদেশ নয়। রাজু ভাস্কর্যের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে আসমানে উড়তে চাওয়া নারীর প্রতিচ্ছবিই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এবং এটিই অমোঘ এবং শেষ উচ্চারণ।

লেখক : কবি, লেখক।

এইচআর/জিকেএস