এআই প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে বিপ্লব এনে দিয়েছে। তবে এই অগ্রগতির পাশাপাশি এক অদৃশ্য সংকটও জন্ম নিচ্ছে—সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা এমন এক বাস্তবতায় বাস করছি, যেখানে চোখে দেখা, কানে শোনা বা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও পাওয়া তথ্য—সব কিছুই প্রশ্নের মুখে। এআই প্রযুক্তি দিয়ে মিথ্যাকে সত্যের মতো উপস্থাপন করা যাচ্ছে, আবার সত্যকেও এমনভাবে বিকৃত করা সম্ভব হচ্ছে, যা এক ভয়াবহ বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে।
Advertisement
এটি কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যা নয় বরং একটি গভীর মানবিক সংকট। আমি নিজেই একদিন সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও দেখে বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম—সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতার উসকানিমূলক বক্তব্য দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু পরে জানা গেলো, সেটি ছিল একটি ‘ডিপফেইক’ ভিডিও। এতটাই নিখুঁতভাবে বানানো হয়েছিল যে সাধারণ চোখে তার ভিন্নতা ধরা পড়ার কোনো উপায় ছিল না।
এই অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দিলো—আমরা এমন এক সময়ের মধ্যে প্রবেশ করেছি, যেখানে ‘প্রমাণ’ মানেই আর সত্য নয়। প্রশ্ন হলো—এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় কী? প্রযুক্তিই যখন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে, তখন সেটিকেই কি আমরা সত্য উদঘাটনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি?
বিষয়টি গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায়—সমস্যার উৎস এআই নয় বরং আমরা যেভাবে এটিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, সেটাই মুখ্য। এআই নিজে থেকে কিছু সৃষ্টি করে না, সে শেখে। আর যদি আমরা তাকে বিকৃত, পক্ষপাতদুষ্ট ও অসত্য তথ্য দিই, সে তার ভিত্তিতে বিভ্রান্তিকর ফলাফলই তৈরি করবে। কিন্তু যদি তাকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও নৈতিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়, তাহলে সেই প্রযুক্তিই আমাদের সত্যের অনুসন্ধানে সাহায্য করতে পারে।
Advertisement
তবে এজন্য শুধু প্রযুক্তির উন্নয়ন যথেষ্ট নয়, দরকার মানুষেরও মানসিক ও নৈতিক উন্নয়ন। যেমন—Explainable AI নামক একটি ধারণা সামনে এসেছে, যা এআইকে তার সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য করে। একইসঙ্গে ফ্যাক্ট-চেকিং প্রযুক্তি, সোর্স ট্রেসিং অ্যালগরিদম এবং স্বয়ংক্রিয় তথ্য যাচাই ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি। এগুলো আরও উন্নত ও সহজলভ্য করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রযুক্তিনির্ভর তথ্য ব্যবস্থাপনায় নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু প্রযুক্তিগত দিক বাদ দিলেও, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো—সাধারণ মানুষের সচেতনতা। তথ্য গ্রহণের আগে তার সত্যতা যাচাই করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। জনগণকে মিডিয়া লিটারেসি শেখাতে হবে—শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার নয়, প্রযুক্তির প্রভাব, ঝুঁকি এবং সত্য-মিথ্যার বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা দিতে হবে। একজন সচেতন মানুষ কখনোই একটি সন্দেহজনক ভিডিও বা তথ্য যাচাই না করে তা বিশ্বাস করবে না বা শেয়ার করবে না।
আমাদের ছোটোবেলা থেকেই শেখানো হয়—সদা সত্য কথা বলিবে, কখনও মিথ্যা বলিবে না। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় সেই সত্যকে সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। যখন একজন শিশু বড় হয়ে দেখে, মিথ্যাই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, তখন সে সত্যের মূল্য হারিয়ে ফেলে। এটি শুধু প্রযুক্তিগত বা সামাজিক সমস্যা নয় বরং এক গভীর নৈতিক সংকট।
তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাস বলে, মানুষ সবসময়ই নিজ ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে এমন দিন আসতে পারে, যখন এআই শুধু তথ্য বিশ্লেষণ নয় বরং নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও মানুষকে সহায়তা করবে। সেই দিন হয়ত এখনো দূরে, কিন্তু তার বীজ আমরা আজই বপন করতে পারি।
Advertisement
তবে কেবল মানুষকে সচেতন করলেই হবে না, প্রযুক্তিকেও ‘নৈতিকভাবে সচেতন টুল’ বানাতে হবে। এআই যেন কোনো পরিস্থিতিতেই দুর্নীতির মুখোমুখি না হয়, বা মিথ্যাকে সত্য প্রমাণের জন্য ব্যবহৃত না হয়, সেজন্য তাকে এমনভাবে নকশা ও নিয়ন্ত্রিত করতে হবে, যেন সে সন্দেহজনক আদেশ বা তথ্যকে নিজে বিশ্লেষণ করে প্রতিরোধ করতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো AI Alignment ও Constitutional AI-এর মতো ধারণা নিয়ে কাজ করছে—যেখানে এআইকে শেখানো হচ্ছে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করতে হয়। এটাই হবে ভবিষ্যতের প্রযুক্তির সুরক্ষা-ব্যূহ—যেখানে মেশিন শুধু কমান্ড শুনবে না, তা বিচার করেও দেখবে।
আমাদের হাতে এখন দুটি পথ—প্রযুক্তিকে নির্বিচারে গ্রহণ করে বিভ্রান্তির শিকার হওয়া, অথবা সচেতনভাবে ব্যবহার করে তাকে সত্যের অন্বেষণে রূপান্তরিত করা। সত্যের জন্য লড়াই এখন কেবল নৈতিক কর্তব্য নয়, এটি এক সমাজবিনির্মাণের সংগ্রাম। প্রযুক্তি যদি বিভ্রান্তির হাতিয়ার হতে পারে, তাহলে সেটিকেই সত্যের অস্ত্র বানানো সম্ভব—শর্ত একটাই, প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ যেন মানুষের বিবেকের হাতে থাকে।
— রহমান মৃধাগবেষক ও লেখকসাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেনrahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস