গত কয়েকদিন ধরে দেশের সব কাস্টমস হাউজে চলেছে কলমবিরতি কর্মসূচি। কর্মকর্তারা দুপুর তিনটার পর কাজ শুরু করতেন। এর প্রভাবে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে তৈরি হয়েছে কনটেইনার জট। সোমবার (১৯ মে) কলমবিরতি স্থগিত করলেও বন্দরে কনটেইনার জমে তা ছাড়িয়েছে ৪৪ হাজার টিইইউস।
Advertisement
এর পাশাপাশি ১৯টি অফডকেও রয়েছে ৮৬ হাজার টিইইউস কনটেইনার। গত ১৯ দিনের ব্যবধানে আট হাজারের বেশি কনটেইনার বেড়েছে বন্দর অভ্যন্তরে। সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে কর্মকর্তাদের কলমবিরতিতে তৈরি হয়েছে এ জট।
বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরে খালাস কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় বাজারে পণ্যের সরবরাহে সংকট তৈরি হয়ে বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। আর বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, কাস্টমস ও চারটি অফডকে জটিলতার কারণে পণ্য খালাস কিছুটা কম হওয়ায় কনটেইনার বেড়েছে। তবে চলতি সপ্তাহের মধ্যেই খালাস স্বাভাবিক হয়ে জটলা কমে আসবে।
কর্মকর্তাদের কলমবিরতির কারণে গত কয়েকদিন কাস্টমসের স্বাভাবিক কাজ বিলম্বিত হয়েছে। সোমবার কলমবিরতি স্থগিত করলেও অনেক ফাইলের কাজ জমেছে কাস্টমসে। স্বাভাবিক শুল্কায়ন কার্যক্রম না হওয়ায় পণ্য খালাস কার্যক্রমও বিলম্বিত হচ্ছে।- চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক এএসএম রেজাউল করিম স্বপন
Advertisement
জানা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে জারি করা অধ্যাদেশের প্রতিবাদে কাস্টমস কর্মকর্তারা ১৫ মে সকাল থেকে প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে কর্মবিরতি শুরু করেন। কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতিতে স্থবির হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে। এতে দেশের বৃহত্তম এ কাস্টমস হাউজে আমদানি ও রপ্তানিপণ্যের ওপর শুল্কায়নসহ সব ধরনের কার্যক্রম বিঘ্ন ঘটছে। মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েছেন আমদানি-রপ্তানিকারকরা। আমদানি-রপ্তানিপণ্য মিলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাত হাজার বিল অব এন্ট্রি ও বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল হয় চট্টগ্রাম কাস্টমসের।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় (১৯ মে পর্যন্ত) চট্টগ্রাম বন্দর অভ্যন্তরে ৯ হাজার ২৪৩ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি কনটেইনার বন্দরে এসেছে ৫ হাজার ৮১৩ টিইইউস এবং রপ্তানি পণ্যবাহী ও খালি কনটেইনার জাহাজীকরণ হয়েছে ৩ হাজার ৪৩০ টিইইউস। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙর মিলে পণ্য ও কনটেইনারবাহী ১১১টি জাহাজ বর্তমানে অবস্থান করছে। এর মধ্যে ৫৪টিতে অপারেশন চললেও বসে রয়েছে ৫৭টি।
গত ৩০ এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, ওইদিন বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার ছিল ৩৫ হাজার ৯৭৩ টিইইউস। ওইদিন বন্দরের জেটি ও বহির্নোঙর মিলে পণ্য ও কনটেইনারবাহী জাহাজ ছিল ১০৪টি। এর মধ্যে ৬৩টি জাহাজে পণ্য খালাস ও কনটেইনার খালাস চলে। গত সপ্তাহখানেক আগেও চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ছিল ৪০ হাজার ৭৮ টিইইউস। জাহাজ ছিল ১০৩টি। এর মধ্যে ৬০টি জাহাজে হ্যান্ডলিং চলছিল।
আরও পড়ুন
Advertisement
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় জাহাজ থেকে কনটেইনার বন্দরে নেমেছে ৫ হাজার ৮১৩ টিইইউস, ঢাকা আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) থেকে এসেছে ১১৫ টিইইউস। অফডকগুলো থেকে রপ্তানিপণ্য ভর্তি কনটেইনার এসেছে ২ হাজার ১৭৮ টিইইউস এবং খালি কনটেইনার এসেছে ৭৫২ টিইইউস।
একইভাবে ৩ হাজার ৪৩০ টিইইউস কনটেইনার জাহাজীকরণ হয়েছে। ১১৬ টিইইউস কনটেইনার ঢাকা আইসিডিতে পাঠানো হয়েছে। অফডকগুলোতে আমদানিপণ্য ভর্তি কনটেইনার পাঠানো হয়েছে ৮৯১ টিইইউস। বন্দর থেকে এক হাজার ২৭ টিইইউস খালি কনটেইনার অফডকগুলোতে পাঠানো হয়েছে। ১৩শ ৪৪ টিইইউস আমদানিপণ্যবাহী কনটেইনার সরাসরি আমদানিকারকদের ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্দর অভ্যন্তর থেকে ১৬শ ৪১ টিইইউস কনটেইনার পণ্য খালাস দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের একদিকে ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে বন্দরেও কনটেইনারের জট তৈরি হচ্ছে। আবার স্বাভাবিকভাবে পণ্য খালাস না হওয়ায় বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। পণ্যের কস্ট অব প্রোডাকশন বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে কাস্টমস ও বন্দর ঘিরে একটি অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।- আমদানিকারক মাহবুব রানা
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের কলমবিরতির কারণে পণ্যের শুল্কায়ন বিলম্বিত হওয়ার প্রভাব পড়েছে বন্দরে। পাশাপাশি শুল্কায়ন বিঘ্নিত হওযায় আমদানি করা ভোগ্যপণ্য খালাস বিলম্বিত হওয়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক এএসএম রেজাউল করিম স্বপন বলেন, ‘কর্মকর্তাদের কলমবিরতির কারণে গত কয়েকদিন কাস্টমসের স্বাভাবিক কাজ বিলম্বিত হয়েছে। এতে ফাইলের স্তূপ জমা হয়েছে। সোমবার কলমবিরতি স্থগিত করলেও অনেক ফাইলের কাজ জমেছে কাস্টমসে। স্বাভাবিক শুল্কায়ন কার্যক্রম না হওয়ায় পণ্য খালাস কার্যক্রমও বিলম্বিত হচ্ছে।’
বাংলাদেশ নন-প্যাকার্স ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আমদানিকারক মাহবুব রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাস্টমসে কলমবিরতি পালন করছেন কর্মকর্তারা। বিকেল ৩টার পর তারা কাজ করলেও প্রতিদিনের ফাইলগুলোর কাজ শেষ করতে পারছেন না। এতে শুল্কায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে বন্দর থেকে যথাসময়ে পণ্য খালাস বিঘ্নিত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এতে ব্যবসায়ীদের একদিকে ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে বন্দরেও কনটেইনারের জট তৈরি হচ্ছে। আবার স্বাভাবিকভাবে পণ্য খালাস না হওয়ায় বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। পণ্যের কস্ট অব প্রোডাকশন বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে কাস্টমস ও বন্দর ঘিরে একটি অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।’
বন্দরে সোমবার ৪৪ হাজারের বেশি কনটেইনার রয়েছে। গত কয়েকদিন কিছু বেড়েছে। তারপরেও চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার। কাস্টমস কর্মকর্তাদের কলমবিরতি স্থগিত হওয়ায় এ সপ্তাহের সামনের তিন-চারদিন পণ্য খালাস আরও দ্রুততর হবে।-বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক
অন্যদিকে, বেসরকারি চারটি অফডকে নিয়োগপত্রের দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেছে ট্রান্সপোর্ট ঠিকাদার সরবরাহকারীদের মাধ্যমে সরবরাহ করা প্রাইমমুভার ও লরি চালক-হেলপাররা। সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের এসএপিএ-ইস্ট, এসএপিএল-ওয়েস্ট, ওসিএল ও ভারটেক্স অফডক লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেডের ১৫০টি প্রাইমমুভার ও লরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ওই চার অফডক তাদের নিজস্ব লরি দিয়ে সীমিত সংখ্যক কনটেইনার বন্দরে আনা-নেওয়া করতে পারছেন।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে ৭৮-৭৯ হাজার কনটেইনার থাকলেও বর্তমানে ১৯টি অফডকে আজ (১৯ মে) খালি ও পণ্যভর্তি প্রায় ৮৬ হাজার কনটেইনার রয়েছে। চারটি অফডকের বেসরকারি ঠিকাদারের ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকরা কর্মবিরতি করার কারণে তাদের অপারেশন কিছুটা বিঘ্ন হলেও অন্যগুলোতে কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কাস্টমস কর্মকর্তাদের কলমবিরতির প্রভাব বেসরকারি ডিপোগুলোতে পড়েনি। কারণ, আমাদের ডিপোগুলোতে স্বাভাবিক সময়েও কাস্টমস দুপুর ২টার পর কাজ শুরু করে। কলমবিরতির কারণে ৩টার পর শুরু হলেও অফডকগুলোর অপারেশনে কোনো প্রভাব পড়েনি।’
এ ব্যাপারে বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্দরে সোমবার ৪৪ হাজারের বেশি কনটেইনার রয়েছে। গত কয়েকদিন কিছু বেড়েছে। তারপরেও চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার। এখনো আরও ৯ হাজার কনটেইনার রাখা যাবে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কলমবিরতি স্থগিত হওয়ায় এ সপ্তাহের সামনের তিন-চারদিন পণ্য খালাস আরও দ্রুততর হবে। এতে কনটেইনারের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/জেডএইচ/