বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার স্বপ্ন অনেকেরই। কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না, প্রস্তুতি নিতে হবে গোড়া থেকে। সময় ব্যবস্থাপনা, খরচের পরিকল্পনা, থাকা-খাওয়া, সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো—এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে বিদেশের জীবন। বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগে ও পরে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো জানা থাকলে তেমন বেগ পেতে হয় না। এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওবারলিন কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আবরার হিমেল—
Advertisement
সময় ব্যবস্থাপনাযখন আপনি দেশে থাকবেন; তখন থেকেই সময় ব্যবস্থাপনার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কারণ এখানে এসে পড়াশোনা আর কাজ দুটো একসাথে সামলাতে হবে। যদি আগে থেকেই পরিকল্পনা করে চলার অভ্যাস করেন, তাহলে চাপ অনেকটাই কমে যাবে এবং জীবনও সহজ হয়ে যাবে। ইউটিউবে প্রচুর ভালো সময় ব্যবস্থাপনার ভিডিও আছে, সেগুলো দেখে নতুন টিপস শিখে নিতে পারেন। পাশাপাশি সময় ঠিকভাবে ম্যানেজ করতে কিছু টুলস ব্যবহার করলে আরও ভালো হয়।
গুগল ক্যালেন্ডারের ব্যবহারক্লাস, কাজ, মিটিং, অ্যাসাইনমেন্টের ডেডলাইন—সব কিছু এক জায়গায় লিখে রাখবেন। রিমাইন্ডার সেট করলে সময় ভুলে যাওয়ার ঝামেলা থাকবে না। যেমন- নিজের পড়াশোনা, কাজের তালিকা, ডেইলি প্ল্যানিং—সব একসাথে সাজিয়ে রাখতে পারেন। এটা খুব ফ্লেক্সিবল, নিজের মতো করে কাস্টমাইজ করতে পারবেন। আমি নিজেও এই টুল দুটি ব্যবহার করি। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে আপনার পড়ালেখা আর কাজের ভার অনেক হালকা লাগবে।
ক্যাম্পাসের ভেতর চাকরিআমেরিকায় বা অন্য দেশে পড়াশোনার জন্য আসার আগেই খোঁজ নেওয়া শুরু করেন কীভাবে ক্যাম্পাসে চাকরি পাওয়া যায়। ক্যাম্পাসের চাকরিগুলো শুধু আয়ের জন্য নয় বরং নেটওয়ার্কিং ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যও দারুণ সুযোগ তৈরি করে। আমি নিজে আইটি ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছি। কাজের সুবাদে ক্যাম্পাসের অনেক অফিসার এবং ফ্যাকাল্টির সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছি। যা ভবিষ্যতে রেফারেন্স বা সুপারিশের জন্য অনেক কাজে আসে। বিশেষ করে ‘রেসিড্যান্ট অ্যাসিস্টেন্ট (আরএ)’ হওয়ার চেষ্টা করেন। রেসিড্যান্ট অ্যাসিস্টেন্ট (আরএ) হয়ে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের থাকার খরচ এবং খাবারের খরচ অনেকটাই কমে আসে। এটি শুধু আর্থিক সুবিধা নয় বরং লিডারশিপ স্কিল তৈরির এক দারুণ সুযোগ। রেসিড্যান্ট অ্যাসিস্টেন্ট (আরএ) হতে চাইলে শুরু থেকেই হল ম্যানেজার এবং বর্তমান রেসিড্যান্ট অ্যাসিস্টেন্টদের (আরএ) সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ইতিবাচক সম্পর্ক ও সক্রিয় উপস্থিতি আপনার সুযোগ অনেক বাড়িয়ে দেবে। মনে রাখবেন, ক্যাম্পাসে ছোট ছোট সংযোগই একদিন বড় সুযোগের দরজা খুলে দেয়।
Advertisement
আর্থিক ব্যবস্থাপনাযুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ জিনিসপত্রের দাম আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এখানে অনেক মানুষ ব্র্যান্ডের দামি পোশাক পরে বা বিলাসবহুল গাড়ি চালায়। এসব দেখে প্রভাবিত হওয়ার দরকার নেই। মনে রাখবেন, বাহ্যিক চাকচিক্যের আড়ালে অনেকেই ঋণের ভারে ডুবে আছে, সবাই ধনী নয়। তাই নিজের সাধ্যের মধ্যে থাকা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। পারলে বাজেট ম্যানেজমেন্টের জন্য কোনো অ্যাপ ব্যবহার শুরু করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘You Need a Budget (YNAB)’ নামের অ্যাপটি ব্যবহার করি। এখানে প্রথম একবছর ফ্রি ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়া যায়। অ্যাপটি আমাকে আয়-ব্যয়ের হিসাব পরিষ্কারভাবে বুঝতে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ সীমিত করতে দারুণভাবে সাহায্য করেছে।
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারবাংলাদেশে থাকাবস্থায় অনেক সময় ব্যাংক অফিসাররা ক্রেডিট কার্ড নিতে পরামর্শ দিতে পারেন। তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলবো, আমেরিকায় আসার আগে দেশে কোনো ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার দরকার নেই। আমার কয়েকটি দেশে সফরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই বলবো, ভালো একটা ক্রেডিট কার্ড থাকলে সত্যিই অনেক সুবিধা হয়। যেমন- কেনাকাটায় বিশেষ ছাড় বা ক্যাশব্যাক পাওয়া যায়। ট্রাভেল রিওয়ার্ড পয়েন্ট জমে, যা দিয়ে ফ্লাইট টিকিট বা হোটেলে বড় ধরনের ছাড় পাওয়া যায়। ক্রেডিট স্কোর বাড়ানোর জন্যও খুবই কার্যকর, যা ভবিষ্যতে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া বা গাড়ি কেনার সময় অনেক কাজে আসবে। এ ছাড়া আমেরিকায় বা অন্য দেশে এসে স্টুডেন্টদের জন্য ডিসকাভার বা অন্য ভালো কোম্পানির ক্রেডিট কার্ড নেওয়া খুবই সহজ। এটি শুধু আপনার ক্রেডিট স্কোর তৈরিতেই সহায়তা করবে না বরং ভবিষ্যতে অনেক বড় সুবিধাও দেবে।
আরও পড়ুন সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে কেমন কর্মজীবী নারীরা কতটা নিরাপদ?অফার এবং ডিসকাউন্ট খোঁজাযখন কোনো কিছু কিনতে বা সার্ভিস নিতে যান, অফার বা ডিসকাউন্ট আছে কি না খোঁজ নিন। যেমন- CHASE ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুললে তারা $২০০ বোনাস দেয়। তবে কিছু শর্ত থাকে, তাই সব সময় শর্তগুলো পড়ে বুঝে এগোবেন। এ ছাড়া রেস্তোরাঁ বা দোকানে আপনার স্টুডেন্ট আইডি দেখিয়ে অনেক সময় ডিসকাউন্ট পেয়ে যেতে পারেন। লজ্জা না পেয়ে জিজ্ঞেস করবেন। অনেক সময়, ছোট ছোট জিজ্ঞাসার মধ্যে থেকেই বড় সুবিধা পাওয়া যায়।
ইভেন্ট এবং নেটওয়ার্ক তৈরি প্রথম সেমিস্টারে পড়াশোনার চাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এ সময় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ইভেন্টে এবং ভলান্টিয়ারিং করে কাজে লাগানো যায়। এতে একদিকে যেমন পরিচিতি বাড়বে, অন্যদিকে ক্যাম্পাসের পরিবেশের সাথে দ্রুত মানিয়ে নেওয়া যায়। আমি প্রথমদিকে ক্যাম্পাসের বেশ কিছু ইভেন্টে অংশ নিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা পেয়েছি। বিশেষ করে ক্যাম্পাসের অফিসার, শিক্ষক, প্রশাসক সবার সাথে পরিচিত হওয়ার দারুণ সুযোগ থাকে। তাদের বেশিরভাগই অনেক বন্ধুসুলভ এবং সহযোগিতাপূর্ণ। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে হাতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী কোনো উপহার নিতে পারলে ভালো। যেমন- নকশিকাঁথা বা হাতের তৈরি কোনো জিনিস। এগুলো অনেকেই পছন্দ করে এবং মনে রাখে।
Advertisement
সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণশুধু পড়াশোনার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। সময় বের করে মডেল ইউনাইটেড নেশন (এমইউএন), কনফারেন্স, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আর ইন্ট্রামুরাল খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করবেন। এসব কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার ফলে নেতৃত্ব, যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বেড়ে যায়। এ ছাড়া অনেক সময় ইউনিভার্সিটি এসব অ্যাক্টিভিটিতে অংশ নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীর ভ্রমণ, থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য খরচ বহন করে। আমি নিজেই অনেক বন্ধুকে দেখেছি; যারা সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোর মাধ্যমে বিদেশের বিভিন্ন শহরে বিনা খরচে ভ্রমণের সুযোগ পান।
আপনজন ছেড়ে থাকার প্রস্তুতিবিদেশে আসার আগে পরিবার থেকে দূরে থাকার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। বিভিন্ন উৎসব, ঈদ, পূজা-পার্বণের মতো বিশেষ দিনগুলো আগের মতো পরিবার নিয়ে উপভোগ করা যাবে না। অনেক সময় ঈদের দিনও ক্লাস বা কাজের চাপ থাকতে পারে। এমনকি অসুস্থ হলে বা কোনো সমস্যায় পড়লে পাশে পরিবারের কেউ থাকবে না। এজন্য একা থাকার জন্য মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে। নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের সঙ্গে মেশা আর একা থাকার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। তবে সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই সহজ হয়ে আসে।
সিম কার্ড এবং ইন্টারনেটের ব্যবহারআমেরিকায় ইন্টারনেট এবং মোবাইল বিল সাধারণত অনেক বেশি হয়। তবে এক ধরনের সুবিধা হলো Affordable Connectivity Program (ACP), যা ফ্রি বা কম দামে ইন্টারনেট পাওয়ার সুযোগ দেয়। প্রোগ্রামটির মাধ্যমে মোবাইল এবং ইন্টারনেটের জন্য কিছু কম খরচে পরিষেবা পেতে পারেন। এ প্রোগ্রামে আবেদন করতে হলে আপনার ট্যাক্স ডকুমেন্ট প্রয়োজন হবে।
ড্রাইভিং লাইসেন্সড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলে বিদেশে চাকরি বা ইন্টার্নশিপের অনেক সুযোগ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গাড়ি না কিনতে পারলে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া একেবারে সুবিধাজনক। এটি শুধু কাজের সুযোগই বাড়ায় না, পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতা আনে। লার্নারস পারমিট পাওয়ার জন্য ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও রয়েছে, যা আপনাকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করবে। এর মাধ্যমে আপনি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবেন এবং প্র্যাকটিসের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।
মেজরের পাশাপাশি অন্য ক্লাসকলেজে পড়াশোনা করার সময় মেজরের পাশাপাশি জেনারেল অ্যাডুকেশন (GenEd) ক্লাস নিতে হয়। ক্লাসগুলো অনেক সময় মেজরের চেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই সহজ সাবজেক্ট বেছে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। বিদেশে ভাষা কোর্স বাধ্যতামূলক হয়। সে ক্ষেত্রে স্প্যানিশ নেওয়া তুলনামূলক সহজ হবে। ভাষা কোর্সগুলোতে অনেক সময় স্প্যানিশ সবচেয়ে সহজ এবং জনপ্রিয় অপশন হয়ে থাকে।
এসইউ/জিকেএস