তপ্ত রোদের মধ্যে বিরামহীনভাবে ধান কেটে চলেছেন হাবিবুর রহমান ও নুরুন্নাহার দম্পতি। হাবিবুরের নিজের সম্বল বলতে রয়েছে মাত্র ৩০ শতক জমি। এই জমিতে চাষাবাদের পাশাপাশি দিনমজুরি করে চালাতে হয় সংসারের খরচ।
Advertisement
হাবিবুর-নুরুন্নাহার দম্পতি জানান, ধান কাটার জন্য তারা কম্বাইন হারভেস্টার পাচ্ছেন না। হারভেস্টার মেশিন মালিকের কাছে গেলে চাওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। অতিরিক্ত টাকা দিতে রাজি হলেও দেওয়া হচ্ছে লম্বা সিরিয়াল। অন্যদিকে শ্রমিক সংকট। দু-একজন শ্রমিক মিললেও দৈনিক মজুরি হাজার টাকার কমে কাজ করতে রাজি না তারা। এ অবস্থায় নিজেরাই ধান কেটে বাড়িতে নিয়ে মাড়াই করছেন এই দম্পতি।
হাবিবুর-নুরুন্নাহার দম্পতি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়া ইউনিয়নের আলালপুর গ্রামের বাসিন্দা। শুধু যে এই দম্পতি রোদে পুড়ে ধান কাটছেন তা নয়; ময়মনসিংহ জেলাজুড়ে হারভেস্টার মেশিন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা ও কৃষি শ্রমিক সংকটের কারণে বহু কৃষক স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ধান কেটে গোলায় তুলতে ব্যস্ত।
এর পাশাপাশি কৃষকদের ক্ষুব্ধ করছেন ধান ব্যবসায়ীরা। তারা ন্যায্য দাম না দিলেও মণে অতিরিক্ত ২-৩ কেজি বেশি রেখে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ কৃষকদের।
Advertisement
কৃষকরা জানান, এবছর কীটনাশক, সারসহ শ্রমিকদের মজুরি বেশি দিয়ে ধান চাষ করা হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে বেশি। বেশিরভাগ কৃষকদের বোরো ধান পেকে গেছে। হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এজন্য ধান কাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ১০ শতাংশ ধান কাটতে হারভেস্টার মেশিন মালিকদের দিতে হচ্ছে ১০০০-১২০০ টাকা। এর কম দিতে চাইলে ধান কেটে দিচ্ছেন না তারা। এজন্য ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়াসহ নানা কারণে দিশেহারা কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষি অফিস বলছে, গতবছর দুই লাখ ৬৩ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে। এবছর দুই লাখ ৬৩ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে ধান উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজার ৭৫২ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত ৩৮ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। জেলায় হারভেস্টার মেশিন রয়েছে ২৯৪টি। এরমধ্যে প্রায় ৩০টির মতো নষ্ট রয়েছে। শুধু ময়মনসিংহ সদরে হারভেস্টার মেশিন রয়েছে ১৬টি। এর সবগুলোই সচল।
আরও পড়ুন:
মেশিনে চাষাবাদে বেড়েছে ফলন, কমেছে পরিশ্রম-খরচজিআই স্বীকৃতি পেলো কিশোরগঞ্জের পনির ও রাতাবোরো ধানতারা ধানক্ষেতের অদৃশ্য প্রহরীসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হারভেস্টার মেশিন দিয়ে এক একর (১০০ শতক) জমির ধান কেটে পাঁচ হাজার ৪০০ টাকার বেশি নিতে পারবেন না হারভেস্টার মেশিন মালিকরা। এ হিসেবে প্রতি ১০ শতক জমির ধান কেটে ৫৪০ টাকা নিতে হবে।
Advertisement
সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়া ইউনিয়নের আলালপুর গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জমির সব ধান পেকে গেছে। প্রতি ১০ শতক ধান কাটতে হারভেস্টার মেশিন মালিকরা ১০০০-১২০০ টাকা চাচ্ছেন। তাদের নির্ধারিত ওই টাকা দিতে রাজি হলেও সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একই ইউনিয়নের খালপাড় এলাকার কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, ধান বিক্রি করতে হলে এক মণ ধানের জন্য তিন কেজি ধান বেশি নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অথচ সব ধান শুকনা। বাড়তি ধান না দিলে কেনেন না ব্যবসায়ীরা।
ময়মনসিংহ মহানগরীর শম্ভুগঞ্জ ধান ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা কৃষকদের বাধ্য করে বাড়তি ধান নিচ্ছেন। আমি মনে করি, কৃষকদের সঙ্গে এসব ব্যবসায়ীরা জুলুম করছেন। বাজারের সব ব্যবসায়ীদের বাড়তি ধান নিতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু তারা আমার কথা মানছেন না। কৃষকদের স্বার্থে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো প্রয়োজন।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক ড. নাছরিন আক্তার বানু জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি ১০ শতক জমির ধান কাটার জন্য ৫৪০ টাকার বেশি নিতে পারবেন না হারভেস্টার মেশিন মালিকরা। অতিরিক্ত টাকা আদায় করে কৃষকদের হয়রানির চেষ্টার প্রমাণ মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, কৃষকরা ধান বিক্রি করতে গেলে ব্যবসায়ীরা ধান বেশি রাখছেন কি-না তা আমার জানা নেই। বিষয়টি জেলা প্রশাসন কিংবা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নজরে আনা হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ বিভাগের উপপরিচালক রিনা বেগম বলেন, বাড়তি ধান নিয়ে কৃষকদের ঠকানো যাবে না। তবে এই মুহূর্তে আমাদের কাছে ধান পরিমাপের যন্ত্র নেই। অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হবে। ধান পরিমাপের যন্ত্র পেলে বাজারে অভিযান চালানো হবে।
এসআর/জেআইএম