গত ২২ এপ্রিল ভারতের কাশ্মীরের পহেলগামের পর্যটন এলাকায় হঠাৎ করেই পাঁচ থেকে ছয়জন জঙ্গি হানা দিয়ে ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি পর্যটককে হত্যা করে। হামলাকারীরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দিব্বি পালিয়ে যায়। সারা পৃথিবী থেকেই এই সন্ত্রাসী হামলায় নিন্দার ঝড় ওঠে। এমনকি পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকেও। হামলার পরপরই ভারত অভিযোগ করে এটি লস্করই তৈয়বা নামক সন্ত্রাসী সংগঠনের কাজ এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এর পেছনে রয়েছে।
Advertisement
পাকিস্তানের সরকার তথা সেনাবাহিনী তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে। কিন্তু লস্করই তৈয়বার শাখা সংগঠন দি রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট অব কাশ্মীর এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এই সংগঠনটির অপারেশনের টার্গেট হয় কাশ্মীরের নিরাপত্তা বাহিনী, সরকারি কর্মচারী এবং পর্যটকরা। ভারতের দাবি, ওই সংগঠনের প্রশিক্ষণ হয় পাকিস্তানের মাটিতে, অতএব পাকিস্তানের মাটিতে হামলা করেই এর বিনাশ করতে হবে।
দুই সপ্তাহ টানটান উত্তেজনার পর ৭ মে ভারত পাকিস্তানের ৯টি স্থাপনায় আক্রমণ করলো। ভারত বলেছে, এ হামলায় পাকিস্তানের মিলিটারি বা বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হয়নি। এই বিবৃতির মধ্যে একটি বৈপরিত্যে আছে। যদি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদতে এবং প্রশিক্ষণে ওই ঘাঁটিগুলো হয় তাহলে তো মূল দায়ী হওয়ার কথা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর! তাহলে সেনাবাহিনীকে টার্গেট করা হয়নি এমন বিবৃতির কোনো প্রয়োজন ছিল কি? যা হোক, ৭ মে’র এই হামলার পর সারা পৃথিবী নড়েচড়ে বসেছে এবং সর্বস্তরের মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আবারও কি পাকিস্তান এবং ভারত বড় আকারের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে?
কঠিন প্রশ্ন বটে! ভারত ৭ তারিখের হামলার পর আর সামনে আগাতে চাচ্ছে না। কারণ সামরিকভাবে পাকিস্তানের চেয়ে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হলেও যুদ্ধ বা সংঘাত বড় আকার নিলে ভারতকেও চরম খেসারত দিতে হবে। তথাপি এই ঝুঁকি ভারত নিয়েছে, তাকে নিতে হয়েছে। কারণ কিছু একটা করার, একটা বদলা নেওয়ার চাপ ভারতের অভ্যন্তরে সরকার অনুভব করেছে।
Advertisement
আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এই দুই দেশে যেন বড় আকারের যুদ্ধ না হয় সেই চেষ্টা করছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিজে ইয়েমেন, গাজা এবং ইউক্রেন নিয়ে পুরোপুরি ইনভলভ। তারপরও সব হিসাব-নিকেশ কখনো কখনো পাল্টে যায়। তাই ভবিষ্যৎ বিষয়টিও অনিশ্চিত, সেটা দুদিন পরের ভবিষ্যৎই হোক, আর দুই দশক পরের ভবিষ্যৎই হোক।
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও বিশ্বাস করেছে যে ২২ এপ্রিল পহেলগাম হামলার পেছনে পাকিস্তান রয়েছে এবং সরকারের বদলা নেওয়াটা কর্তব্য। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরে সরকারের নিরাপত্তা ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। কী করে পহেলগামের মতো একটি পর্যটন এলাকায় সন্ত্রাসীরা হামলা করে এতগুলো মানুষ হত্যা করে পালিয়ে গেলো?
ভারতীয় নিরাপত্তায় নিয়োজিত হাজার হাজার সদস্য কোথায় ছিল, কেন তারা ঠেকাতে পারেনি, কেন সন্ত্রাসীদের ধরতে পারেনি- এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে। সেই সমালোচনার ঝড়ের গতি দিন দিন বাড়তেই থাকে। ফলে মানুষকে শান্ত করতে প্রাথমিকভাবে ভারত সিমলা চুক্তি বাতিল ও পাকিস্তানের সঙ্গে ইন্দুস ওয়াটার ট্রিটি বা সিন্দু নদের পানি চুক্তি বাতিল করে এবং আপস্ট্রিম কান্ট্রি হিসেবে পানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান এটিকে যুদ্ধের শামিল বলে উল্লেখ করে। তাতে হয়তো ভারত সরকার তৃপ্ত হতো। কিন্তু ভারতেই তখন প্রশ্ন ওঠে, ছয়টি নদী দিয়ে পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ যায়, সরকারের কটি বাঁধ আছে পানি ঠেকাবার?
২২ এপ্রিলের পর নরেন্দ্র মোদী সরকার ঘোষণা দিয়েছে এক ফোটা পানি পাকিস্তানে যাবে না। কিন্তু ভারতের নদী বিশেষজ্ঞরাই বলেছেন, পাকিস্তানে পানির প্রবাহ বন্ধ করতে হলে বিশাল বিশাল অন্তত ২২টি বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। তাছাড়া পুরো পানি বন্ধ করে দিলে কাশ্মীরের ৪ হাজার কিলোমিটার সমতল ভূমি ১৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। অতএব এটিকে ভারতের সচেতন মহল আইওয়াশ বলে ধরে নেয়। দ্বিতীয়ত, শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতের অভ্যন্তরে কোনো কোনো মহল থেকেও অভিযোগ ওঠে, এ হামলা ভারতেরই সাজানো। এই চাপের মুখে প্রাথমিক পর্যায়ে দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে।
Advertisement
আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধে দুই দেশের কারওই যে খুব একটা ক্ষতি হবে তা নয়। কারণ দুই দেশের বাণিজ্য ভলিউম খুবই ছোট। এরপর দুই দেশই নিজেদের আকাশ সীমা বন্ধ করে দেয়। এতে অবশ্য পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের ক্ষতির পরিমাণ বেশি। কারণ ভারত থেকে পশ্চিম ও উত্তরের দেশগুলোর দিকে প্রায় সব বোয়িং পাকিস্তানের আকাশ সীমা ব্যবহার করে। এতে জ্বালানি খরচসহ ভারতের মোটা অঙ্কের ব্যয় হবে এভিয়েশনে। ভারত বিষয়টি দীর্ঘায়িত না করে একটি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ করে থেমে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বহু কারণে এখন আর ২০১৬ সালের উরি হামলা এবং ২০১৯ সালে পুলবমা হামলার পর যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করার অবস্থা ছিল, তা নেই।
এখন হামলার অর্থই ছিল বড় ঝুঁকি নেওয়া। কারণ ২০১৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেলর কমর জাভেদ বাজওয়া। তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত শান্ত। বর্তমানে সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনির আহমেদ শাহ। অসিম মুনির ভারতের কোনো রকম হামলা মেনে নিতে নারাজ। তিনি ব্যক্তিগত জীবনেও অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ এবং ভয়ানক ভারতবিরোধী। তিনি মানসিকভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তাতে ফলাফল যাই হোক না কেন। এই সবকিছু বুঝেও নরেন্দ্র মোদী সরকারের ওপর চাপ বাড়তেই থাকে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আক্রমণ ছাড়া আর গতি থাকে না।
ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা তৈরি হলেই সারা পৃথিবী নড়েচড়ে বসে। এর কারণ দুটি দেশেই রয়েছে পরমাণু অস্ত্র। ১৯৪৫ সালের পর বিশ্বে অনেক ছোট ও বড় যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু হিরোশিমা নাগাসাকির পর আর কোনো স্থানে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। এর প্রধান কারণ দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশ আর পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। কিন্তু পাকিস্তান এবং ভারত চির বৈরী এবং পরমাণু শক্তিধর।
সুতরাং দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে পরমাণু ব্যবহার হতে পারে বলে মনে করে বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো। দ্বিতীয়ত, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পরোক্ষ তো বটেই, এমনকি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বের অনেকগুলো দেশ। উপরে আনুষ্ঠানিক শান্তির বিবৃতি থাকলেও তলে তলে দুটি দেশের প্রতি দুটি ভিন্ন বলয়ের সমর্থন রয়েছে। ভারতের সঙ্গে সহযোগিতায় প্রস্তুত ইসরায়েল, রাশিয়া এবং বর্তমানে ব্রিটেন। সম্প্রতি ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের ফ্রি ট্রেড চুক্তি তাদের সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন রয়েছে চীন, মধ্যপ্রাচ্যের দু-একটি দেশের।
ইরানের ক্ষেত্রে হিসাবটা হলো, যেহেতু ইসরায়েল ভারতের প্রতি সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে বা দেবে, তাই পাকিস্তান পাবে ইরানের সমর্থন। আর যুক্তরাষ্ট্র? তার হিসাব বড়ই জটিল। ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক ভালো হলেও পাকিস্তানের মিলিটারির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের রয়েছে দীর্ঘকালের কানেকশন। যতই তারা ইসলামিক টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধাচরণ করুক, তারা সরাসরি কোনো সামরিক সাহায্য ভারতকে দেবে বলে মনে হয় না। কিন্তু বিপদের কথা হলো, আরেক শক্তিশালী দেশ চীন বড় যুদ্ধ হলে পাকিস্তানকে নিশ্চিতভাবেই সামরিক সাহায্য দেবে। সুতরাং জয় পরাজয়ের হিসাবে বড় ঝুঁকি আছে উভয় দেশের জন্যই।
এই মুহূর্তে, অর্থাৎ এই লেখার সময় যতটা জানা যায় লাইন অফ কন্ট্রোলে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। এটাই বরাবর দেখা গেছে। দুপক্ষের শতাধিক সামরিক ও বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছে। ছোটবড় যে কোনো যুদ্ধের সময় উভয় পক্ষ তাদের সামরিক শক্তির আধিপত্যের গল্প তৈরি করে। এক্ষেত্রেও তা দেখা যাচ্ছে। দুই দেশের মিডিয়াই নিজে দেশের কৃতিত্বের খবর ফলাও করে প্রকাশ করছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখনো স্পষ্ট নয়। এ যুদ্ধ আরও সম্প্রসারিত হবে কি না তা অনেকটাই নির্ভর করছে দুপক্ষের বন্ধু দেশগুলোর পরামর্শ এবং চাওয়া না চাওয়ার ওপর। আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দুই দেশকেই উত্তেজনা প্রশমনে আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। তবে ইতোমধ্যে যে ড্যামেজ হয়েছে তা দুটি দেশে বৈরিতাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
এই মুহূর্তে বল এখন পাকিস্তানের হাতে। পাকিস্তানের সরকার তথা সেনাবাহিনীও একটি অভ্যন্তরীণ চাপে আছে হামলার জবাব দেওয়ার। পাকিস্তান ইতিমধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের শপথ নিয়েছে। সেটা নিতে গেলেও যে বড় যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে তা পাকিস্তানের অজানা নয়। তবে জাতি হিসেবে আপস বিষয়টি পছন্দ করে না। তাছাড়া সরকার ভারতের ওপর দৃশ্যমান প্রতিশোধমূলক হামলা না করলে জনগণের একটি চাপ কাঁধের ওপর পড়বে, যা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং জেনারেল অসিম মুনিরের ওপর বর্তাবে।
তবে নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত ধারণা, আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এই দুই দেশে যেন বড় আকারের যুদ্ধ না হয় সেই চেষ্টা করছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিজে ইয়েমেন, গাজা এবং ইউক্রেন নিয়ে পুরোপুরি ইনভলভ। তারপরও সব হিসাব-নিকেশ কখনো কখনো পাল্টে যায়। তাই ভবিষ্যৎ বিষয়টিও অনিশ্চিত, সেটা দুদিন পরের ভবিষ্যৎই হোক, আর দুই দশক পরের ভবিষ্যৎই হোক।
লেখক: সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।
এইচআর/এএসএম