দেশের বিচার বিভাগে এখনো ফ্যাসিস্ট আমলের বিচারকরা বহাল তবিয়তে কাজ করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এখনো ৯০ শতাংশ বিচারক ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের। অবিলম্বে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিচারপতি নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন তারা।
Advertisement
বুধবার (৭ মে) ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর আইন কর্মকর্তাদের পদত্যাগ ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিচারপতি নিয়োগের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও আইনজীবী সমাবেশে’ এ দাবি জানান আইনজীবীরা।
‘বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজের’ ব্যানারে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা এ সমাবেশের আয়োজন করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা বাদল।
সভায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, বিএনপির সময় বেগম খালেদা জিয়া আইন কর্মকর্তা ও বিচারক নিয়োগে সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদী দলের আইন সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ করতেন। তিনি (আইন সম্পাদক) কী করবেন তাকে বলে দেওয়া হতো। বলা হতো আপনি (আইন সম্পাদক) বারের সভাপতির সঙ্গে আলাপ করবেন, সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ করবেন। তারপর রিপোর্টের ভিত্তিতে দক্ষ বিচারপতি নিয়োগ করবো। সেভাবেই বিএনপি করেছে।
Advertisement
তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে একটু ভুল হয়েছিল। চারজন বিচারপতি নিয়োগ হয়েছিল। তখন আইন সম্পাদক, বারের সভাপতি ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। তাতে দেখা গেলো দুজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ। পরে বারের পক্ষ থেকে বলার পর তাদের শপথ পড়ানো হয়নি। তখন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিয়োগের গেজেট বাতিল করেছিলেন।
জয়নুল আবেদীন বলেন, বারকে (সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি) বলতে চাই, আপনারা এখনো ঘুমাচ্ছেন। আর আমরা শুনছি বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেছে। গোপনে গোপনে আপনারা (সরকার) কাদের নিয়োগ দিচ্ছেন? আইন কর্মকর্তা যেভাবে নিয়োগ হয়েছে সেভাবে? আইনজীবীরা সেটা হতে দেবে না। বারের দায়িত্ব রয়েছে এগুলো দেখার। কারা গত ১৭ বছর তাদের পেশাকে রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কারা ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। এখন আপনারা সব সুশীল হয়ে গেছেন? সুশীল হলে চলবে না।
তিনি বলেন, যারা ১৭ বছর আন্দোলন করেছে তাদের অবশ্যই রাখতে হবে। অন্যথায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম এই দেশে সর্ববৃহৎ আইনজীবীদের সংগঠন। প্রায় ৯০ হাজারের মতো আইনজীবী আছেন। তার মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য। কাজেই আমরা কিন্তু বসে থাকবো না। আমরা দেখবো আপনারা (সরকার) আগামী দিনে কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা যখন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতাম তখন স্বৈরশাসকের দোসররা এসে বাধা দিতো। তারা আমাদের সভা পণ্ড করার জন্য চেষ্টা করতেন। আজ যারা সরকারি আইন কর্মকর্তা হয়েছেন তাদের অনেককে সে সময় মাঠে দেখিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। আপনারা ভালোই ভালোই চলে আসুন।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, চিন্তা করতে পারিনি আমাদের আজও দাঁড়াতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বর্তমান সরকার সত্যিকার অর্থে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার চায় কি না? কারণ যে শেখ হাসিনাকে বিদায় করতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছিল। সেই শেখ হাসিনার সমর্থনপুষ্ট ও অন্ধভক্ত রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা অনেকে নিয়োগ পেয়েছেন। আগে থেকে এখনো পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আছেন।
Advertisement
তিনি বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই অভিযুক্তের বিচার যিনি করবেন তিনিই যদি আইন কর্মকর্তা হোন তাহলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো বিচার হবে? এখন তাই দেখতে পাচ্ছি। অনেক আইন কর্মকর্তা ছাত্রলীগ-যুবলীগ করতেন। অবিলম্বে তাদের পদত্যাগ করতে হবে বা মন্ত্রণালয় তাদের বরখাস্ত করুন। অন্যথায় আইনজীবীরা সচিবালয় পর্যন্ত যবে। বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া নাকি শুরু হয়েছে। আমাদের স্পষ্ট দাবি স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। ওই অধ্যাদেশ নিয়ে শুনানি শেষে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। আগে পর্যবেক্ষণ দেখবো আমরা। তার আগেই যদি অধ্যদেশের আলোকে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে আইনজীবী সমাজ মেনে নেবে না।
এছাড়া আইনজীবী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, গত ১৭ বছর সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করেছি। আমরা ভেবেছিলাম বাংলাদেশে বিচারের নামে আর অবিচার হবে না। এখন দেখছি সর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকেছে। যারা এখনো ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষে কাজ করছেন অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। ভালোই ভালোই বাড়িতে চলে যান। আমরা আপনাদের কোর্টে প্র্যাকটিস করতে দেবো না। আমার সুশীল বিচারপতি দরকার নেই। আমার দরকার যে সঠিক বিচার করতে পারবেন এবং যিনি গণতন্ত্রমনা একজন বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ১০ আগস্টের ইতিহাস আপনি ভুলে যাবেন না। ওইদিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে জুডিসিয়াল ক্যু হওয়ার কথা ছিল। আমরা সেদিন জুডিসিয়াল ক্যু ব্যাহত করেছি। যদি সেই জুডিসিয়াল ক্যু সফল হতো তাহলে আমরা যেকজন ছিলাম সবার গলায় ফাঁসির দড়ি পড়তো। আমাদের সেই ঝুঁকির বিনিময়ে আজ আপনি প্রধান বিচারপতির চেয়ার অলংকৃত করছেন। এসব ত্যাগ মনে রেখে আপনাকে বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট ইউনিট নেতা অ্যাডভোকেট গাজী তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নেতা ও ঢাবি আইন সমিতির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনির হোসেন, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট শহীদুল ইসলাম ও মাহবুবুর রহমান খান। উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান ও অ্যাডভোকেট মো. মাকসুদ উল্লাহসহ কয়েকশ আইনজীবী।
এফএইচ/বিএ/এএসএম