ভারতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ-সাশ্রয়ী হলো স্থলপথ। শনিবার (১৭ মে) দেশটি স্থলপথে তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশ থেকে বেশকিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। এতে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন রপ্তানিকারকরা। বিষয়টি নিয়ে কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নয়, কূটনৈতিকভাবে সমাধানের কথা ভাবছে সরকার।
Advertisement
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই দেশের বিগত কয়েকটি অ-শুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) আরোপের মতো পদক্ষেপের কারণে ‘রেসিপ্রোকাল মুভ’ বা পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে শেষমেশ স্থলবন্দর ব্যবহারে এ নিষেধাজ্ঞা এলো। যে কারণে আবারও কোনো নতুন পাল্টা পদক্ষেপ নয়, কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে স্থলবন্দর ব্যবহারের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে। ওই সময় দুই দেশের নেওয়া অন্য বিধিনিষেধ নিয়েও আলোচনা হবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারত যে পদক্ষেপ নেওয়ার সেটা আলাপ-আলোচনা ছাড়াই নিয়েছে। এখন এ নিয়ে আমরা কী পদক্ষেপ নেবো সেটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেজন্য আমরা যে আবার আরেকটা পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেবো, সেটা ভাবছি না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চিন্তা-ভাবনা করে আলোচনায় যেতে চাচ্ছি ভারতের সঙ্গে। আমরা আমাদের রপ্তানির ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করছি এখন। তারপর কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবো।’
Advertisement
আরও পড়ুন
স্থলপথে নিষেধাজ্ঞা, জরুরি সভা ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খরচ বাড়বে ৫ গুণ, ভারতের বাজার হারানোর শঙ্কায় রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে নতুন নিষেধাজ্ঞা ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে বাংলাদেশের সময়-খরচ বাড়বেবাণিজ্য সচিব আরও বলেন, ‘এক দেশের একটি পদক্ষেপ, তার পাল্টা পদক্ষেপ অন্য দেশের- এগুলো শত্রুতার জন্ম দেয়। যেটা দুই দেশের বাণিজ্যের জন্য ভালো নয়। তাতে উভয় দেশ কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেটা আমরা করতে চাচ্ছি না। দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে এ বিষয়টি সমাধান করতে চাই।’
আমরা চিন্তা-ভাবনা করে আলোচনায় যেতে চাচ্ছি ভারতের সঙ্গে। আমরা আমাদের রপ্তানির ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করছি এখন। তারপর কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবো।- বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান
তিনি বলেন, ‘দুই দেশের ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের নিয়ে আমাদের একটি ফোরাম আছে (সিইও ফোরাম), আমরা সেখানে ভারতকে আলোচনার প্রস্তাব পাঠাচ্ছি। পাশাপাশি আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে আরও সুনির্দিষ্ট আশু করণীয় নির্ধারণের চেষ্টা করছি।’
Advertisement
এ বিষয় করণীয় ঠিক করতে মঙ্গলবার (২০ মে) জরুরি সভা ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ও আশু করণীয় নির্ধারণে বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়া এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিদের উপস্থিতির জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আয়েশা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অনেক স্টেকহোল্ডার এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে কাল (২০ মে) আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার পরে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আসবে। এরপর আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নেবো।’
নতুন করে ভারত যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তার বিপরীতে আমাদের পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, আমাদের সেই বাজার সক্ষমতা (মার্কেট পাওয়ার) নেই। নিজেদের ক্ষতি করে অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা করা যাবে না।-পিআরআই চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার
সার্বিক বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, আমরা পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের মাধ্যমে এগোচ্ছি। প্রথমে তারা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করলো। পরে আমরা স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলাম। এরপর ভারত স্থলবন্দর বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলো। ফলে যে কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সব দিক ভালোভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘নতুন করে ভারত যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তার বিপরীতে আমাদের পাল্টা পদেক্ষপ নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, আমাদের সেই বাজার সক্ষমতা (মার্কেট পাওয়ার) নেই। নিজেদের ক্ষতি করে অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা করা যাবে না। তাই এখন পাল্টা পদক্ষেপ না নিয়ে কূটনৈতিকভাবে এই বাধা দূর করার চেষ্টা করা উচিত।’
এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ প্রত্যাশা করছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘এ ধরনের অ-শুল্ক প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য জটিলতা তৈরি করবে। দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করবে।’
কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সমাধানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথমে জানতে হবে কেন এটি আরোপ করা হয়েছে, তারপর দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে উভয় দেশকে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। আর ভারত সরকারের উচিত কারণ ব্যাখ্যা করা, কেন তারা এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বচ্ছতার অংশ।’
এ ধরনের অ-শুল্ক প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য জটিলতা তৈরি করবে। দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করবে।- সানেম নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান
ভারতের এ সিদ্ধান্ত ওই দেশের বেশির ভাগ মূল ধারার সংবাদমাধ্যম সেটিকে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবেই বর্ণনা করছে। তাদের দাবি, সম্প্রতি ঢাকা ভারতের রপ্তানিতে যেসব অ-শুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) আরোপ করেছে, তার জবাবেই দিল্লির এ সিদ্ধান্ত।
গত এপ্রিলে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে নিজ দেশের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য যাওয়ার ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে ভারত। এরপর ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করে বাংলাদেশ। এরপর স্থলবন্দর ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করলো ভারত।
এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/এমএস