মতামত

জেনে শুনে বিষ পান করছি!

জেনে শুনে বিষ পান করছি!

করোনা মহামারিতে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অর্থনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এরপরও নতুন একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে মানুষ। সেটি হচ্ছে প্রকৃতির আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়া। করোনার এই দু-তিন বছরে মানুষের সর্বগ্রাসী অত্যাচার থেকে অনেকটাই রক্ষা পেয়েছে প্রকৃতি।

Advertisement

জনবহুল পর্যটন স্পটগুলো জনশূন্য হওয়ায় সেখানকার পশুপাখি নিরাপদে ঘুরে বেরিয়েছে। কলকারখানা বন্ধ থাকায় দূষণ কমছে। কমেছে কার্বন নিঃসরণ। শুধু চীনেই ২০ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে ১০ শতাংশ। ফলে জলবায়ু বিশুদ্ধ হয়েছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছে মানুষ। ধুলায় ধূসর ঢাকা, দিল্লি ও বেইজিংয়ের আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। স্বচ্ছ পানিতে ডলফিনের ঘোরাফেরা দেখা গেছে।

করোনার সময় মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগেছে অক্সিজেন সংকটে। মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ায় গাছ কাটাও কমে যায়। ফলে প্রকৃতিতে বেড়ে যায় অক্সিজেনের সরবরাহ। পৃথিবী ভরে যায় সবুজে। কোভিড-১৯ এর অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার বন্ধ করে তার কাছে ফিরে যাওয়া। সহাবস্থান না করে অত্যাচার চালালে মানুষও যে টিকতে পারবে না-এটিই যেন বলে দিচ্ছে করোনা মহামারি।

বাস্তবতা হচ্ছে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার আমরা থামাইনি। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ-এই প্রবাদ বাক্য আমরা জানি। কিন্তু কতটা মানছি সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ প্রাণ ধারণের জন্য যে শ্বাস অর্থাৎ বাতাস আমরা গ্রহণ করছি সেটি কতটা স্বাস্থ্যকর এটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বায়ু দূষিত হলে সেটি জীবন রক্ষার চেয়ে জীবন কেড়ে নেওয়াতেই বেশি ভূমিকা রাখবে। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, রাজধানী ঢাকার বাতাসের মান অত্যন্ত খারাপ। এমনকি বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে আমরা গোটা পৃথিবীতে শীর্ষ অবস্থান করছি। এই লেখা যেদিন লিখছি (৫ মে ২০২৫)  সেদিনও দূষণের শীর্ষে ঢাকা। বোঝার সুবিধার্থে এদিনের রিপোর্ট থেকে তুলে ধরছি-‘বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে রাজধানী ঢাকা। সোমবার (৫ মে) সকাল ৮টা ১৯ মিনিটে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের  আইকিউএয়ার) সূচক থেকে জানা গেছে এ তথ্য।

Advertisement

তালিকার শীর্ষে অবস্থান করা ঢাকার বায়ুর মানের স্কোর হচ্ছে ১৯৮। এর অর্থ দাঁড়ায় এখানকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সৌদি আরবের রিয়াদ। এই শহরটির দূষণ স্কোর ১৯৭ অর্থাৎ এখানকার বাতাসও অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। তৃতীয় নম্বরে রয়েছে পাকিস্তানের করাচি। চতুর্থ ভিয়েতনামের হ্যানয় আর পঞ্চম অবস্থানে পাকিস্তানের আরেক শহর লাহোর।

অর্থাৎ স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয় বায়ুর মান। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। (সূত্র : জাগো নিউজ ৫ মে, ২০২৫) বলা বাহুল্য এই দূষণের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী।

বায়ুর মান দেখে সহজেই অনুমেয় আমরা কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। পরিবেশের অন্যান্য দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার নানাবিধ উপায় থাকলেও বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। এ অবস্থায় আমরা প্রতিক্ষণ যে শ্বাস নিচ্ছি তাতে আসলে বিষ গ্রহণ করছি। এবং তা জেনে শুনে। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো-জেনেশুনে বিষ করেছি প্রাণ/প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।’

বায়ুদূষণ হলো বাতাসে এমন পদার্থের উপস্থিতি যা মানুষ, অন্যান্য জীব বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। দূষণকারী পদার্থ হতে পারে ওজোন বা নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো গ্যাস , কাচের মতো ছোট ছোট কণা বা সিসার মতো অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ। এটি বাইরের বাতাস এবং ঘরের বাতাস উভয়কেই প্রভাবিত করে।

Advertisement

পরিবেশবিদ পার্কিন্স তার রচিত ‘এয়ার পলিউশন’ বইতে বলেছেন যেন ঘরের বাইরের আবহমণ্ডলে এক বা একাধিক সংক্রামক বস্তু যেমন- বিষাক্ত ধোঁয়া, ধূলিকণা, গ্যাস, কুয়াশা, কাঁকর, ধোঁয়াশা অথবা বাষ্পের যে পরিমাণ উপস্থিতি ও যতক্ষণ স্থায়ী হলে মানুষ, জীবজন্তু অথবা উদ্ভিদ জগতের পক্ষে ক্ষতিকারক, তাকেই বায়ুদূষণ বলা হয়।

অযান্ত্রিক যান চলাচল বাড়িয়ে পরিবহনজনিত বায়ুদূষণ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। এজন্য পরিবেশবান্ধব সাইক্লিংকে উৎসাহিত করা যায়। উন্নত বিশ্বে বড় বড় শহরেও সাইকেল চালানোর আলাদা লেন আছে। আমাদের দেশে সাইকেল তো দূরের কথা ফুটপাতও দখল করে রাখে।

প্রতি বছর ১৫ জুন বিশ্ব বায়ু দিবস পালন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বায়ুদূষণ সম্পর্কে মানুষজনকে সচেতন করা। বায়ুদূষণের ভয়াবহতা এতই ব্যাপক যে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন শ্বাসের মাধ্যমে দূষিত বায়ু গ্রহণ করছে। বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগে বছরে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। এই তথ্য জাতিসংঘের।  সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’র ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা ৭৬.৯। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ১০-এর কম।

বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পরে রয়েছে চাদ, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, ভারত, ওমান, কিরগিজস্তান, বাহরাইন, ইরাক ও নেপালের নাম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর নয়াদিল্লি (ভারত)। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরের সমীক্ষা অনুযায়ী বায়ুদূষণের ফলে কমছে মানুষের আয়ু। হাঁপানি, ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, ফুসফুসের অসুখসহ অনেক রোগের কারণ বায়ুদূষণ। এ রোগ বৃদ্ধির জন্যও বায়ুদূষণ দায়ী। বায়ুদূষণের দৈনিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা মোট বিশ্ব উৎপাদনের ৩ থেকে ৪ শতাংশ।

বায়ুদূষণ তাদেরই বেশি প্রভাবিত করে, যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যু সরাসরি পিএম ২.৫-জনিত বায়ুদূষণের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া বায়ুতে থাকা দূষণের মাত্রা বাড়ার ফলে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতি ঘণ্টায় ৮০০ জন।

নানাভাবেই বায়ুদূষণ হচ্ছে।  বায়ুদূষণের প্রাকৃতিক উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে দাবানল , ধুলো ঝড় এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। রান্না এবং গরম করার জন্য জৈব বস্তু (যেমন কাঠ) ব্যবহারের কারণে প্রায়শই অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ হয়। সামগ্রিকভাবে, বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছে যে বায়ুদূষণের ফলে কল্যাণ ক্ষতি (অকাল মৃত্যু) এবং উৎপাদনশীলতা ক্ষতি (শ্রম হারানো) বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রতি বছর ৮ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি করে।

মানব উৎস থেকেও বায়ুদূষণ হয়। এবং এটাই বেশি। বেশিরভাগ বায়ুদূষণ শিল্প, নির্মাণ, পরিবহন এবং তাপীকরণের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে হয়, যদিও অন্যান্য অনেক উপায়েও মানুষ বায়ুদূষণ করে। পারমাণবিক অস্ত্র , বিষাক্ত গ্যাস, জীবাণু যুদ্ধ এবং রকেট প্রযুক্তি বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হতে পারে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ হয়। লিগনাইট এবং কয়লা সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ করে , তারপরে তেল। জীবাশ্ম গ্যাস এবং জৈববস্তুপুঞ্জ পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ কম হয়।  তেল এবং গ্যাস উৎপাদনে মিথেন লিক হওয়া সাধারণ। 

২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, চীনে উৎপাদন ও নির্মাণ খাত বায়ুদূষণের ৫০ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে। নির্মাণ, সংস্কার এবং ধ্বংস ধুলো তৈরি করে, পাশাপাশি অন্যান্য দূষণকারী পদার্থও তৈরি করে। যদিও অনেক দেশে নিষিদ্ধ, অ্যাসবেস্টস পুরোনো ভবনগুলোতে টিকে থাকে, যেখানে এটি নষ্ট হলে ফুসফুসের রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।

পরিবহন, কৃষি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গৃহস্থালির উৎস থেকেও বায়ুদূষণ হয়। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ২.৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ রান্নার জন্য কাঠ, শুকনো গোবর, কয়লা বা কেরোসিনের মতো দূষণকারী জৈববস্তুপুঞ্জ জ্বালানির ওপর নির্ভর করে, যা ক্ষতিকারক গৃহস্থালি বায়ুদূষণের কারণ হয়। স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব বেশি দেখা যায় নারীদের মধ্যে, যারা রান্নার জন্য দায়ী হতে পারেন এবং ছোট বাচ্চাদের মধ্যে।

বায়ুদূষণের জন্য পরিবহনের কালো ধোঁয়া অনেকটাই দায়ী। ঢাকার লক্কড়-ঝক্কড় মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িগুলো যেন বায়ুদূষণের এক একটা খনি। যানজট এই দূষণকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ঢাকায় মানুষের হাঁটার চেয়েও গড় গতি কম যানবাহনের। এ অবস্থায় যানজট ঢাকা নগরীকে কার্যত এক অচল এবং স্থবির নগরীতে পরিণত করেছে।

এটি একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দেওয়ায় পরিবহন খাতে বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো ছাড়া কোনো উপায় নেই। যানজট সমস্যার সমাধান না হওয়ায় প্রতিদিনই অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে উন্নয়ন। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অগ্রগতি। শুধু তাই নয়, শব্দ ও বায়ুদূষণে নানান সংক্রামক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। যানজটে নগরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাও মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে দিন দিন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সব রুটে যাত্রীদের চলাচলে কমপক্ষে ৩ কর্মঘণ্টা সময় অপচয় হয় প্রতিদিন। যানজটের কারণে বিপুল পরিমাণ জ্বালানিরও অপচয় হয়। জ্বালানি যত বেশি পুড়বে বাতাসে এর বিরূপ প্রভাবও তত।  কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন সময় নানামুখী কর্মসূচি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই কম। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। অথচ দুর্বিষহ যানজটের জন্য পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার অভাবকেই দায়ী করা হয়।

বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো চলছে, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মনোযোগ নাই।’ বলা হয় এসব যানবাহনের কোনো ‘ইকোনমিক লাইফ’ নেই। একটা বাস সাধারণত ১০-১৫ বছর পরিবেশসম্মতভাবে বা ভালোভাবে চলাচল করতে পারে, এটাই ‘ইকোনমিক লাইফ’। উন্নত দেশগুলোতে বাসের ইকোনমিক লাইফ শেষ হওয়ার পর সেগুলোকে সড়ক থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। অথচ আমাদের দেশে লাইফ শেষ হওয়ার পরও রং মেখে ও মেরামত করে পুনরায় রাস্তায় নামানো হয়। ঢাকার সড়কে তাই ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছেই। মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট বসলেও, তা দীর্ঘস্থায়ী বা কার্যকর হয় না।

অযান্ত্রিক যান চলাচল বাড়িয়ে পরিবহনজনিত বায়ুদূষণ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। এজন্য পরিবেশবান্ধব সাইক্লিংকে উৎসাহিত করা যায়। উন্নত বিশ্বে বড় বড় শহরেও সাইকেল চালানোর আলাদা লেন আছে। আমাদের দেশে সাইকেল তো দূরের কথা ফুটপাতও দখল করে রাখে।

ঢাকার যেসব এলাকায় বর্জ্য পোড়ানো হয়, সেইসব এলাকায়ই বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। এছাড়া পাড়া-মহল্লা, বাসাবাড়িতেও বর্জ্য পোড়ানো হয়। পরিবেশবাদীরা বলেন, বর্জ্য পোড়ানোর কারণেও বায়ুদূষণ হয়। ডায়িং বর্জ্য তুরাগ নদীতে ফেলে দূষণের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। জরিমানাও করা হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু দূষণ বন্ধ হয় না। এসব বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে ক্ষতিকর প্লাস্টিক, পলিথিন, রাসায়নিক সামগ্রী, জৈব, অজৈব ও গৃহস্থালি বর্জ্য। শুধু তাই নয়, সাভার অঞ্চলের শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদী-খালে। গাজীপুরের অবস্থাও একই। সেখানকার জমিজমা পর্যন্ত চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে শিল্প বর্জ্যের দূষণে। এ অবস্থায় এতদঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে নানান রোগব্যাধি।

ঢাকা দিন দিন বাস অনুপযোগী শহর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় লোকজনকে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। যত্রতত্র যখন তখন খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ধুলার। সকালবেলা বাসা-বাড়ি থেকে বের হয়ে লোকজনকে রীতিমতো ধুলায় গোসল করে ফিরতে হয়। হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে উঁচু তলায়ও পৌঁছে যাচ্ছে ধুলা। গাড়ি দিয়ে পানি ছিটালে ধুলি দূষণ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। কিন্তু সিটি করপোশেন এই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে না।

ওয়াসা, ডেসা, তিতাস- এক সংস্থা রাস্তা খুঁড়ে কাজ শেষ করে তো আরেক সংস্থা শুরু করে। এতে যেমন রাষ্ট্রের অর্থের শ্রাদ্ধ হয় তেমনি ভোগান্তিও বাড়ে। বাড়ে দূষণও। এক মন্ত্রণালয়ের সাথে আরেক মন্ত্রণালয়ের কাজের কোনো সমন্বয় না থাকায় যুগ যুগ ধরে চলছে এই জগাখিচুড়ি অবস্থা। তাছাড়া উন্মুক্ত ট্রাকে বহন করা হচ্ছে বালি, পাথর। এগুলোও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। ধূমপানের কারণেও বাড়ছে বায়ুদূষণ। এতে ব্যক্তি নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি দূষণেও রাখছে নেতিবাচক ভূমিকা। অথচ স্বাস্থ্যসচেতন হলেই ধূমপানজনিত দূষণ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।

বায়ুদূষণ রোধে বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে উন্নত বিশ্বে। এরমধ্যে রয়েছে কড়া আইন ও নীতিমালা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার এবং জন সচেতনতা। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এসব পদক্ষেপের ফলে অনেক শহর এবং দেশ তাদের বায়ু গুণমান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে।

এখনই এর লাগাম টেনে না ধরতে পারলে শ্বাসজনিত নানান রোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যানসার এবং জিনেটিক পরিবর্তনজনিত নানান অজানা রোগে ভুগতে হতে পারে চরমভাবে। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাবে তেমনি অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদনশীলতাও ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে। তাপমাত্রা ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। পাল্টে যাচ্ছে ঋতুর ধারাক্রম। ফলে মানুষের চিরচেনা স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহই আজ ব্যাহত।

প্রকৃতির সঙ্গে প্রাণিকুলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য পরিবেশ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। লেখার মাধ্যমে এদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশবাদী সংগঠন নিয়ে বেশি করে খবর প্রকাশ করতে হবে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। বায়ুদূষণ- সামগ্রিকভাবে পরিবেশসংক্রান্ত আইন-কানুন নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করাও পরিবেশ সাংবাদিকতার অংশ। পরিবেশ মন্ত্রণালয় আছে, আছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের কার্যক্রম নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে পরিবেশ সাংবাদিকতার গতি-প্রকৃতি ও পরিধি বাড়াতে হবে। এবং তা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।

drharun.press@gmail.com

এইচআর/ এমএফএএমএফএ/জেআইএম