নোয়াখালীর উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচরের হারিছ চৌধুরীর বাজার ওরফে আটকপালিয়া বাজারে ইরি-বোরো ধান কাটার মৌসুমে হরহামেশা বেচাকেনা চলছে শিশু শ্রমিক। অভাবের তাড়নায় স্কুলের বই আর খেলার সামগ্রী রেখে এখন শিশুরা বাধ্য হচ্ছে কাস্তে-কোদাল হাতে নিতে।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হারিছ চৌধুরীর বাজারে প্রতি শুক্র ও সোমবার বসে শ্রমিক বেচাকেনার হাট। এখান থেকে মহাজনরা তাদের পছন্দের শ্রমিক সংগ্রহ করে কাজে লাগান। পরিবারের খরচ জোগাতে অনেক অভিভাবক শিশুদের এ হাটে বিক্রি করছেন।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) আটকপালিয়া বাজারে শ্রমিক বিক্রির হাটে গিয়ে দেখা যায়, বড়দের সঙ্গে অসংখ্য শিশুও নিজের শ্রম বিক্রি করতে এসেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে মহাজনদের কাছে বিক্রি হওয়ার অপেক্ষায়।
এদের অনেকের পরনে ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পোশাক। তাদের হাতে রয়েছে রাতে ঘুমানোর জন্য কাঁথা, ধান কাটার কাস্তে ও কাপড়ের থলে। তাদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।
Advertisement
বিক্রি হতে আসা দরবেশ বাজারের আবদুল কুদ্দুছের ছেলে রিফাত (১২) জানায়, বাড়িতে তার মা একা। সংসার চালাতে টাকার প্রয়োজন। অভাবে পেটের দায়ে সে কাজে এসেছে।
বাড়িতে মাকে ফেলে মহাজনের বাড়িতে একা ঘুমাতে পারবে কি-না জিজ্ঞেস করতেই ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দেয় রিফাত।
কাজের খোঁজে আটকপালিয়া বাজারে এসেছে কিশোর নাজমুল হোসেন (১৩)। সে লক্ষ্মীপুরের রামগতির গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করেই শিশুকাল অতিবাহিত হচ্ছে তার। নাজমুল পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু সংসারের অসচ্ছলতা তাকে এগোতে দেয়নি। টাকার অভাবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটেনি। আসতে হয়েছে কাজের হাটে।
কাজে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানালো, বাবা অসুস্থ থাকায় কাজে আসতে হয়েছে। অন্যথায় পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে থাকতে হবে।
Advertisement
চর মহিউদ্দিনের মৃত আবদুল খালেকের ছেলে জিয়া উদ্দিন (১৪) পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের আর্থিক-অনটন ঘোচাতে জীবিকার সন্ধানে শ্রমিকের হাটে। সে জানায়, লেখাপড়া করে জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও সে স্বপ্ন এখন তার দুঃস্বপ্ন।
গায়ে স্কুলের পোশাক পরিহিত সাইফুর রহমান (১০)। চর মহিউদ্দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সে। মা-বাবা বলেছেন, কাজ করতে যাও। কাজের সন্ধানে দুপুরে এসেছে। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। তবে কাজ পায়নি সে। তার চাহিদা ৪৫০ টাকা, দাম উঠেছে ৩৫০ টাকা।
হাটে চর আমান উল্যাহর হেদায়েতের ছেলে সুমন (১৭), চর মহিউদ্দিনের মো. আলীর ছেলে মো. রুবেল (১৫), আখতার হোসেন (১৭), দরবেশ বাজারের সৈয়দ মকবুলের ছেলে আ. হামিদসহ (৯) আরও অনেক শিশু শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। এদের অনেকে জানায়, কাজে গাফিলতি করলে মজুরি কমে যায় কিংবা কাজ না পারলে চলে আসতে হয়।
শ্রমবাজারের শিশু ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভাব-অনটনে কাজে যাওয়া শিশুদের মজুরি কম, খাটুনি বেশি। বর্তমান বাজারে তাপপ্রবাহের মধ্যে ইরি (বোরো) ধান কাটা ও রবিশস্য খামারের কাজে শিশুদের দৈনিক মজুরি ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। মজুরি কখনো এর চেয়েও কমে যায়। মজুরি কম হলেও খাটুনি ঠিকই ৮-৯ ঘণ্টা, ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। সারাদিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টার বিশ্রামের সময় পায়।
আটকপালিয়া হারিচ চৌধুরীর বাজার ছাড়াও সুবর্ণচর উপজেলায় আরও শ্রমিক বেচাকেনার হাট রয়েছে। এরমধ্যে চরবাটা খাসের হাট, পূর্ব চরবাটা ছমির হাট, চরক্লার্ক বাংলাবাজার, মোহাম্মদপুরের আক্তার মিয়ার হাট ও চরওয়াপদা থানাহাট এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ কাজের খোঁজে বিক্রি হতে আসেন। হাটের দিন নির্ধারিত জায়গায় রাস্তার ওপর থলে, কাঁচি আর আসবাবপত্র হাতে এদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়।
সুবর্ণচরের শহীদ জয়নাল আবেদীন সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি উদ্বেগজনক। অনেক অভিভাবক নিজেদের আর্থিক চাহিদা মেটাতে শিশুদের কাজে পাঠান। এ বিষয়ে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে।’
এ বিষয়ে নোয়াখালী জজ আদালতের আইনজীবী আবুল হোসেন রাজু জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না। একই আইনের ২৮৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে বা চাকরি করার অনুমতি দিলে তিনি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাবেয়া আসফার সায়মা জাগো নিউজকে বলেন, শিশুশ্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকারের বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমরা শিশুশ্রমের বিষয়ে অভিভাবকদের নিরুৎসাহিত করি। এজন্য সমাজকেও সচেতন হতে হবে। শিশুশ্রমের বিষয়ে সঠিক তথ্য পেলে আইন অনুযায়ী অভিযান চালানো হবে।
ইকবাল হোসেন মজনু/এসআর/জিকেএস