পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দিন মহান মে দিবস। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি বড় অংশ—বিশেষ করে গৃহকর্মীরা—এখনো শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও সুরক্ষার বাইরে। তাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু; যাদের জীবন ও কাজের পরিবেশ বহু ক্ষেত্রে মানবাধিকারের ন্যূনতম মানদণ্ডের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
Advertisement
গৃহকর্মীরা প্রতিদিন আমাদের ঘরের কাজ করে দেন—বাড়ি পরিষ্কার, রান্না, বাচ্চা সামলানো, বৃদ্ধের দেখাশোনা ইত্যাদি। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত হয় সম্মানজনক বেতন, সামাজিক নিরাপত্তা, কাজের সুনির্দিষ্ট শর্ত এবং আইনি সুরক্ষা থেকে। গত ২৭ এপ্রিল ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গণসাক্ষরতা অভিযান ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত নীতি সংলাপে এ চিত্র আরও স্পষ্টভাবে উঠে আসে।
গৃহকর্মীদের বাস্তব চিত্র২৭ এপ্রিল সেই সংলাপে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ, যাদের মধ্যে অধিকাংশই অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েশিশু। তারা নানারকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত হলেও তাদের জন্য নেই আলাদা কোনো শ্রমনীতি বা সুরক্ষাব্যবস্থা।’
সংলাপে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘প্রথমত আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। পাশাপাশি দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতায় একটি বিশেষ সেল গঠন করা প্রয়োজন।’
Advertisement
> শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই: এখনো গৃহকর্মীদের জন্য আলাদা শ্রম আইন প্রণীত হয়নি। তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই।> শোষণ ও নির্যাতন: তাদের কাজের পরিবেশে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি রয়ে গেছে।> নির্ধারিত কাজের সময় ও মজুরি নেই: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজের ঘণ্টা বা ছুটির নীতিমালা নেই।> শিশু গৃহকর্মীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া: প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত হওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে।> স্বাস্থ্যসেবার অভাব: কোনো সামাজিক বা স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কাভারেজ তাদের নেই।
গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় করণীয় গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতিজাতীয় শ্রমনীতিতে গৃহকর্মীদের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং গৃহকর্ম সংক্রান্ত একটি পৃথক আইন প্রণয়ন জরুরি। ২০১৫ সালে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা খসড়া করা হলেও তা বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এই কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।
ন্যায্য মজুরি ও কর্মপরিসরের নির্দিষ্ট নিয়মগৃহকর্মীদের কাজের সময়, ছুটি, বিশ্রাম এবং ন্যায্য মজুরি নির্ধারণে বাধ্যতামূলক বিধান থাকতে হবে। কাজের সময়সীমা ৮ ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং ওভারটাইমের নির্দিষ্ট নিয়ম প্রবর্তন করতে হবে।
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিগৃহকর্মীদের জন্য বিশেষ স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করে তাদের পেশাগত দক্ষতা ও বিকল্প জীবিকা উন্নয়নে সহায়তা করা যেতে পারে। সংলাপে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় লাইভলিহুড স্কিল অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়।
Advertisement
শিশু গৃহকর্মীদের ন্যূনতম শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র এবং সান্ধ্য স্কুল চালু করা উচিত। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ উদ্যোগ সমন্বিতভাবে পরিচালিত হতে পারে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধাগৃহকর্মীদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রাম চালু করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকার ও এনজিওদের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।
অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির জন্য সেলশ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি কার্যকর সেল গঠন করা জরুরি, যেখানে ফোন ও অনলাইন উভয় মাধ্যমে অভিযোগ করার ব্যবস্থা থাকবে।
আবাসন সুবিধাযেসব গৃহকর্মী একাকী শহরে আসে, তাদের জন্য নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে আবাসিক সুবিধার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
সচেতনতা বৃদ্ধি ও মনোভাব পরিবর্তনগণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গৃহকর্মীদের মানবাধিকার বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। পরিবারগুলোকে দায়িত্বশীল হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
সম্মান দিয়ে শ্রমের মূল্যায়নগৃহকর্মীরা শ্রমিক। তাদের শ্রম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। মহান মে দিবসের অঙ্গীকার হোক—শ্রমিক পরিচয় ও মর্যাদার আলোয় তাদের জীবন আলোকিত করা।
গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা, ন্যায্যতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা কেবল মানবিক দায়িত্বই নয়; একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত। একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে গৃহকর্মীদের মর্যাদার স্বীকৃতি এবং আইনি সুরক্ষা এখন সময়ের দাবি।
এসইউ/জিকেএস