১৮৮৬ সালের ১ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হাজারো শ্রমিক নেমেছিলেন রাস্তায়- শ্রমের ন্যায্য মূল্য ও প্রতিদিন সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে। তারপর থেকে বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাস স্মরণে দিনটি পালিত হয় ‘মহান মে দিবস’ হিসেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস কেবল একটি দিবস নয়, বরং এটি ইতিহাসের গভীর থেকে উঠে আসা এক সংগ্রামের নিদর্শন।
Advertisement
শ্রমিকদের জীবন দিয়ে সংগঠিত সেই আন্দোলনের প্রতিফলন শুধু মিছিলে নয়; প্রতিফলিত হয়েছে সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রেও। বিশ্বের নানা ভাষা ও সংস্কৃতির চলচ্চিত্রে শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ, সংগ্রাম, আত্মমর্যাদা এবং বিদ্রোহের কাহিনি উঠে এসেছে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্প-সাহসিকতায়। কালে কালে তৈরি হওয়া সেইসব সিনেমা নিয়ে আমাদের আজকের বিশেষ এই আয়োজন-
বাংলাদেশি সিনেমায় গল্পের বাইরেবাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সরাসরি মে দিবস বা শ্রমিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সিনেমা নির্মাণ খুব একটা হয়নি। এমনকি নীল বিদ্রোহের মতো বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসকেও সিনেমায় সরাসরি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়নি। তবে অসংখ্য চলচ্চিত্রে শ্রমিকদের শোষিত জীবনের গল্প ওঠে এসেছে। তারমধ্যে বিশেষভাবে বলা যায় রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ সিনেমার কথা। ২০১৯ মুক্তি পাওয়া ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-ই সম্ভবত একমাত্র চলচ্চিত্র যেখানে শ্রমিক অধিকার, বিশেষ করে পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের জীবনসংগ্রাম সরাসরি চিত্রায়িত হয়েছে। বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে শিমু নামের এক তরুণী নারী শ্রমিককে কেন্দ্র করে দেখানো হয়েছে কীভাবে সে ইউনিয়ন গঠনের জন্য লড়াই করে মালিকদের বিরুদ্ধে, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, এবং আইনের জটিলতার বিরুদ্ধে। এই চলচ্চিত্রে নারী শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর উঠে এসেছে স্পষ্ট ও সাহসীভাবে, যা আজকের সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ নথি।
এরপর উল্লেখ করা যেতে পারে সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘ছায়া বৃক্ষ’ সিনেমার নাম। চা-বাগানের শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও নিত্যদিনের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রটি। পর্দায় চা-শ্রমিকদের জীবনকে ফুটিয়ে তুলতে সিনেমার শুটিং হয়েছে চায়ের শহর রাঙ্গুনিয়া ও শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের সরকারি অনুদানে সিনেমাটি বানিয়েছেন বন্ধন বিশ্বাস। এতে মুখ্য দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিরব হোসেন ও অপু বিশ্বাস। দুজনকেই পর্দায় দেখা গেছে চা-শ্রমিকের ভূমিকায়। অপু বিশ্বাসের প্রযোজনায় বন্ধন বিশ্বাস আরও একটি সিনেমা বানিয়েছেন যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন বাংলার অবহেলিত তাঁতশিল্পের গল্প। সেই ছবির নাম ‘লাল শাড়ি’। ছবিটিতে অপুর সঙ্গে অভিনয় করেছেন সাইমন সাদিক।
Advertisement
এর বাইরে ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ভাত দে’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘বিক্ষোভ’, ‘বিদ্রোহ চারদিকে’সহ আরও অনেক সিনেমাতেই মেহনতি মানুষের সংগ্রাম ও গৌরব সৌরভ ছড়িয়েছে। এসব সিনেমায় কখনো সরাসরি দেখানো হয়েছে শ্রমিকদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের দৃশ্য কখনোবা প্রতীক হয়ে এসেছে বাংলাদেশে শ্রমিকদের শোষণের চিত্র। সেইসঙ্গে দেখানো হয়েছে শ্রমিকদের প্রতিবাদ ও সাহসী পদক্ষেপের অনেক দৃষ্টান্ত।
উপমহাদেশের সিনেমায় শ্রমিকদের মর্যাদাভারত উপমহাদেশে শ্রমিকদের অনেক সিনেমা পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গে। সেই শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই বৃটিশদের শাসনে কলকাতা যখন আধুনিকতার রঙিন পোশাক পরতে শুরু করল তখন থেকেই পাওয়া যায় শ্রমিকদের শোষণের অনেক করুণ গল্প। যার বিপরীতে আছে মেহনতি এসব মানুষের সংগ্রাম ও বিপ্লব-প্রতিবাদের উজ্জ্বল ইতিহাসও। মূলত শ্রমিকদের সেইসব বিপ্লবই পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বাম রাজনীতির বাম্পার ফলন ঘটিয়েছিল। যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও। এইসব বাম চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে ভারতীয় বাংলা সিনেমায়। যেখানে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকদের ছবিগুলোতে স্পষ্টভাবেই শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে।
মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’ (১৯৭৩) একটি রাজনৈতিক থ্রিলারের মোড়কে শ্রমিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক চেতনার গভীর অন্বেষণ। একইভাবে ‘কলকাতা ৭১’ ছবিতে নগর দরিদ্রের ক্ষোভ ও ক্ষুধা সরব হয়ে উঠেছে। এগুলো শুধু সিনেমা নয়—সময়ের প্রতিবাদও ছিল।
ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে উদ্বাস্তু ও প্রান্তিক মানুষের সংকট উপস্থাপিত হলেও সেটির অন্তর্নিহিত শ্রেণিসংগ্রামের প্রতীকী ব্যাখ্যা করা হয় বহু চিত্র বিশ্লেষকে। এইসব চলচ্চিত্র আমাদের দেখায় যে শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর যখন সাহিত্য বা সংবাদপত্রে অনুপস্থিত ছিল, তখন পর্দা ছিল তাদের বড় একটি হাতিয়ার। উত্তমকুমার-সৌমিত্র থেকে শুরু করে অনেক অভিনেতাই শ্রমিক ও শোষিত বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন অসংখ্য সিনেমায়। এমনকি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও রুমা গুহ অভিনীত ‘পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিটিকে মোটাদাগে রোমান্টিক কমেডি হিসেবে দেখা হলেও এতে নারী শ্রমিকদের যে চমৎকার অবস্থান দেখানো হয়েছে তা প্রশংসা পেয়েছিল। সেইসঙ্গে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকের আন্তরিক সম্পর্কের বার্তাও দেয়া হয়েছে সিনেমাটিতে। সেই ধারাবাহিকতা নিয়ে রঞ্জিত মল্লিক, মিঠুন চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত বহু সিনেমায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠি বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের সফল নায়ক হয়ে এসেছেন। প্রজন্মের মশাল অব্যাহত রেখেছেন প্রসেনজিৎ, জিৎ, দেবরাও।
Advertisement
বাংলা ভাষার গন্ডি পেরিয়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সিনেমা বিশেষ করে বলিউডে তাকালে শ্রমিকদের নিয়ে সিনেমার তালিকা আরও দীর্ঘ হয়। সেখানে সরাসরি মে দিবস নিয়ে নির্মাণ খুব বেশি নেই। তবে শ্রমিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ও লড়াই উঠে এসেছে কিছু ব্যতিক্রমী ছবিতে। ‘দো বীঘা জমিন’ (১৯৫৩), ‘শ্রী ৪২০’ (১৯৫৫), ‘নয়া দৌড়’ (১৯৫৭), ‘কালা পাথর’ (১৯৭৯), ‘সালাম বম্বে!’ (১৯৮৮), ‘ব্যান্ডিট কুইন’ (১৯৯৪) ইত্যাদি ছবিগুলোতে শ্রমিকদের গল্প এসেছে বৈচিত্রতা নিয়ে।
হলিউডে যন্ত্রের নিচে মানুষের আর্তনাদহলিউডের ইতিহাসে শ্রমিকদের জীবন নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রও গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তৃত। বিশেষ করে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই ধারাটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ‘মডার্ন টাইমস’ (১৯৩৬) চার্লি চ্যাপলিনের একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র। ব্যঙ্গ করার আড়ালে শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী যান্ত্রিকতায় মানুষের নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার করুণ ছবি দেখানো হয়েছে এখানে। শ্রমিক এখানে এক যন্ত্রের অংশ, যার নিজের কোনো অস্তিত্ব নেই।
‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ (১৯৫৪), ‘নর্মা রে’ (১৯৭৯), ‘মেইটওয়ান’ (১৯৮৭), ‘ব্লাড ডায়মন্ড’ (২০০৬), ‘আই, ড্যানিয়েল ব্লেক’ (২০১৬), ‘স্যরি উই মিসড ইউ’ (২০১৯)- চলচ্চিত্রগুলো আধুনিক পুঁজিবাদের কঠোর বাস্তবতা ও মানবিক মূল্যবোধের টানাপোড়েনকে একধরনের দলিল হিসেবে হাজির করে।
এলআইএ/জিকেএস