কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ। উত্তরাধুনিক শক্তিমান এক অগ্রসর কবি। প্রচারের বাইরে বিদেশের মাটিতে নিভৃতচারী এক মেধাবী কবি। স্বভাবে প্রচার বিমুখ এবং খ্যাতির প্রলোভন মুক্ত। উদার মানবতাবাদী, কাল ও সমাজ সচেতন, প্রগতিপন্থী এ কবির কাব্য-যাত্রা নব্বই দশকে। কবিতার পাশাপাশি বাংলাদেশের আটত্রিশ জন কবির কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এসব অনুবাদ থেকে কারো কারো কবিতা কোরিয়ান, পোলিশ ও রুমানিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়ে আন্তর্জাতিক বেশ কিছু পত্রিকা ও সংকলনে স্থান পেয়েছে।
Advertisement
ইংরেজি অনুবাদে নিজের তিনটিসহ আমেরিকা থেকে পাঁচটি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৬ সালে তিনি ইউরোপীয় কবিতা পুরস্কার ‘হোমার মেডেল’-এ ভূষিত হয়েছেন। নিউইয়র্ক ডিপার্টমেন্ট অব কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের গ্রান্ট পেয়েছেন তিনি। আমন্ত্রিত হয়েছেন চীন, গ্রিসসহ মার্কিন বেশকিছু কবিতা উৎসবে। ২৬ বছর ধরে তিনি আন্তর্জাতিক দ্বিভাষিক কবিতা পত্রিকা ‘শব্দগুচ্ছ’ সম্পাদনা করছেন। কবির নিজের কবিতা অনূদিত হয়েছে আটটি ভাষায়।
বাংলা ও ইংরেজি মিলে তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৪২-এর বেশি। ‘সনেটগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা’, ‘আঁধারের সমান বয়স’, ‘নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ’ ও ‘এক পশলা সময়’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়া ‘স্বতন্ত্র সনেট’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘ছয় কবির সাক্ষাৎকার’ তার গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশ। সম্প্রতি এই কবি মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও দেয়াঙ সম্পাদক মাহমুদ নোমান—
জাগো নিউজ: সকালে ঘুম থেকে উঠে একজন কবি হিসেবে সাধারণত আপনার পরিকল্পনা কী থাকে?হাসানআল আব্দুল্লাহ: এখন তো ছুটি চলছে, তাই স্কুলে যাবার তাড়া নেই। তাছাড়া সম্প্রতি আমি আর্লি রিটায়ার্ডমেন্ট নিয়েছি। একেকদিন একেক রকম। কাল বাগানের গাছগুলোতে পানি দিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। আজ হাঁটতে যাওয়া হয়নি। চা খেতে খেতে বই পড়ছিলাম। কখনো একটু হারমোনিয়াম নিয়েও বসি। লেখালেখির তাড়া থাকলে সেটাও করি। মোটামুটি ক্যাজুয়ালি দিন শুরু হয়। তবে সবার আগে দেখি দেশে-বিদেশের কোনো কবি মেসেজ দিয়েছেন কি না।
Advertisement
জাগো নিউজ: কবিতা কেন লেখেন?হাসানআল আব্দুল্লাহ: হাড্ডি-মজ্জার ভেতরে ঢুকে বসে আছে। না লিখে উপায় থাকে না। একটা লাইন মাথার ভেতরে এসে গেলে সেটা না লেখা পর্যন্ত ভীষণ অস্বস্তিতে কাটে। আবার সেটি লেখার সাথে সাথে অধিকাংশ সময় পরের লাইনগুলো এসে যেতে থাকে।
জাগো নিউজ: আপনার একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। সেখানে সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীকে বলেছেন, আপনি কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চান। এটি কেন? একজন কবিকে কেউ স্বীকৃতি দিতে পারেন বলে মনে হয়?হাসানআল আব্দুল্লাহ: এমন কথা বলেছি! মনে পড়ছে না। আমি তো সব সময় বলি যে, আমি একটি ভালো কবিতা লিখতে চাই। যা কেউ কখনো লেখেনি। কবির আসল স্বীকৃতি তো একটি ভালো কবিতা লেখার ভেতরে নিহিত!
জাগো নিউজ: কবি আল মাহমুদ বলেছেন, আপনার কবিতায় আধ্যাত্মিকতা নেই। আমি মনে করি, আধ্যাত্মিকতা লালন করেন একজন কবি। আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি—হাসানআল আব্দুল্লাহ: সচরাচর আধ্যাত্মিকতা বলতে ধর্মীয় বিশ্বাস ও তার ব্যবহারকে বোঝায়। আল মাহমুদও সেই সরল অর্থে বলেছেন। তবে তিনি এ-ও বলেছেন যে, আমার কবিতায় জগৎ বাস্তবতার স্বরূপ ধরা পড়েছে। তিনি আমার মহাকাব্য ‘নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ’র জন্য প্রকাশক ঠিক করে দিয়েছিলেন। বইটি প্রকাশ পেলে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ মহাকাব্যে যে গিঁট লাগিয়ে দিয়েছিলেন, তুমি তা খুলে দিয়েছো। অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে আল মাহমুদের ওই মন্তব্য শুনে শহীদ কাদরী হেসে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কবিতার আধ্যাত্মিকতা ঈশ্বর বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে না। ওর অন্তর্নিহিত শক্তিই আধ্যাত্মিকতা যা এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে, এক সমাজ থেকে অন্য সমাজের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। পৃথিবীর সিংহভাগ ভালো কবিতার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। আল মাহমুদের প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রেও তাই বলা যায়।’
জাগো নিউজ: আপনার সঙ্গে বহির্বিশ্বের সাহিত্য সমাজে ভালো যোগাযোগ-সম্পর্ক। সেই মতে জানতে চাচ্ছি, বহির্বিশ্বে কোন কোন তরুণ কবিকে আপনি পরিচয় করিয়ে দিতে পেরেছেন?হাসানআল আব্দুল্লাহ: আমি তো ৩৮ জন বাংলাদেশি কবির কবিতা অনুবাদ করে, সেগুলো প্রথমে ‘শব্দগুচ্ছ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছি। পরে নিউইয়র্ক সিটি কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের একটি গ্রান্ট পাই, কনটেমপোরারি বাংলাদেশি পোয়েট্রি নামের অ্যান্থোলজি প্রকাশের জন্য। বইটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশ পাওয়ার পর এখনকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ও প্রায় তিরিশের অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে স্থান পেয়েছে। লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটি এই বইয়ে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলো নিয়ে একটি কোর্সও পড়িয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশেই বইটি পৌঁছে গেছে। এই বইয়ে অর্ধেকের বেশি কবিই সত্তর, আশি, নব্বই ও শূন্য দশকের। এদের কারো কারো কবিতা আবার সেখান থেকে কোরিয়ান ও রোমানিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রক্রিয়াটি চলমান।
Advertisement
জাগো নিউজ: এখনকার কোন কোন তরুণ কবিকে আপনার আলাদা মনে হয় এবং কারা আপনার পছন্দের?হাসানআল আব্দুল্লাহ: আমি কাউকেই তরুণ কবি হিসেবে দেখি না। যিনি একটি ভালো কবিতা লিখতে পেরেছেন; তিনিই কবি। তবে তুমি বয়সের দিক দিয়ে যারা তরুণ নিশ্চয়ই তাদের কথা জিজ্ঞেস করেছো। অর্থাৎ আমার জেনারেশন, মানে নব্বই ও পরবর্তী সময়ের কবি যারা তাদের কথা। অনেকেই বেশ প্রমিজিং। অনেকের বই-ই আমি নিয়মিত পড়ি। সম্প্রতি ‘মগ্নপাঠ’ পত্রিকায় বাংলাদেশের কবিতার পঞ্চাশ বছর নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছি। সেখানে একঝাঁক কবিকে উল্লেখ করেছি। এদের কবিতার প্রবণতা নিয়ে আলাপ করেছি।
জাগো নিউজ: ইদানীং পড়া কার কবিতা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে?হাসানআল আব্দুল্লাহ: অনেকের কবিতা। যেমন বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, রহমান হেনরী, টোকন ঠাকুর, মজনু শাহ, শামীম রেজা, সৌমিত্র দেব, নাজনীন সীমন, আলফ্রেড খোকন, জাহানারা পারভীনসহ অনেক কবি আছেন দেশে ও বিদেশে।
জাগো নিউজ: আপনার লিস্ট দেখে বুঝতে পারছি, একেবারে এখন লিখতে আসা কবিরা আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেননি।হাসানআল আব্দুল্লাহ: না, না। কথাটি ঠিক নয়। আমি যে প্রবন্ধটির কথা আগেই বলেছি, সেখানে প্রচুর কবিকে উল্লেখ করেছি।
জাগো নিউজ: আমি জানতে চাচ্ছি আপনার পছন্দের অনূর্ধ্ব ৪০ কবিদের নাম। এখনকার সিনিয়রদের মধ্যে একটি কথা শোনা যায়, সেটি জুনিয়রদের কবিতা নিয়ে নয়, তারা বলেন—সে আমার অনুজ। প্রায় সিনিয়র আশা করেন, জুনিয়ররা তাদের নিয়ে কিছু বলুক। অথচ ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হবে মনে হয়, আপনি কী বলেন?হাসানআল আব্দুল্লাহ: কবির কোনো সিনিয়র-জুনিয়র নেই। তবে সব কবিকেই সময় দিতে হয়, কার বয়স কতো বা কোন অঞ্চলে থাকেন এটি কবিতার মাপকাঠি নয়। কারো নাম উল্লেখ না করে বলবো, এখনকার কবিরা নিজস্ব সময়কে ধারণ করে অন্তর্জাতিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছেন; যেটা আমাদের কবিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন কখনো অমৌলিক লিখবো, এতটা অধঃপতন যেন আমার না হয়: ইকবাল খন্দকার বই পড়তে গিয়ে অনেক চরিত্রের প্রেমে পড়েছি: নির্জনজাগো নিউজ: বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কবিতার ছন্দ নিয়ে আপনার উল্লেখযোগ্য একটি বই আছে। ছন্দের মধ্যে থাকতে আপনার স্বাচ্ছন্দ্য। কথা হচ্ছে—অনেকে বলেন, তথাকথিত ছন্দে আবদ্ধ না-হলে কবিতা হয় না। তাহলে আমার জিজ্ঞাসা—কবিতা কীভাবে হয়? এ ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাচ্ছি—হাসানআল আব্দুল্লাহ: ছন্দ ‘তথাকথিত’ নয়। ছন্দ কবিতা নির্মাণের একটি কৌশল। শব্দের পরিমিত ব্যবহারের চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমি মোটামুটি দুটি ভাষা একটু-আধটু জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি: বাংলা ও ইংরেজি। এই দুই ভাষায় কোনো বড় কবি পাইনি; যিনি ছন্দ জানতেন না। ইতোপূর্বে তুমি আল মাহমুদের কথা বলেছো, তিনি বলতেন, ছন্দ বন্ধন নয় ছন্দ মুক্তি। ব্রিটিশ কবি এডিথ সিটওয়েল বলেছিলেন, ‘ছন্দের কলকব্জা না জেনে কবিতা লিখতে আসা পণ্ডশ্রম মাত্র।’ জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি যে বিষয়ে কাজ করবো, তার মূল না জেনে কাণ্ডে পানি ঢেলে কি সত্যি কোনো উপকার হবে! হয়তো, হতেও পারে। কবিতা তো কাউকে বলে-কয়ে লেখানো যায় না। কেউ যদি মনে করেন, ছন্দ না জেনেই তিনি ভালো কবিতা লিখছেন, তাহলে তাকে কে বাধা দেবে? কবিতা যে আসলে কিসে হয়, সেটা বলা মুশকিল!
জাগো নিউজ: সনেট নিয়ে আপনার আলোচিত একটা বই—‘স্বতন্ত্র সনেট’। এখানে স্বতন্ত্র কী অর্থে?হাসানআল আব্দুল্লাহ: খুব সোজা কথায় এই সনেট পেত্রার্ক ও শেক্সপীয়রের সনেট থেকে আলাদা। স্তবক বিন্যাস ও অন্ত্যমিলের ধরন দুই দিক থেকেই। সাত-সাতে স্তবক বিন্যাস করে, এই সনেটের অন্ত্যমিল দেওয়া হয়েছে কখগঘকখগ ঙচছঘঙচছ। অন্যান্য সনেট থেকে মূল পার্থক্য এখানেই।
জাগো নিউজ: আপনার কবিতায় বিজ্ঞান ও গণিতের মিতালি দেখি। আপনি গণিতের শিক্ষক—এটাও জেনেছি। জানতে চাই—কবিতার সঙ্গে গণিতের কেমন সম্পর্ক?হাসানআল আব্দুল্লাহ: ভালো প্রশ্ন। এর উত্তর দিতে আমার জীবনের একটা গল্প বলি। আমি যখন নিউইয়র্কের হান্টার কলেজে পড়ি, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে একটা বৃত্তি পাই। আমার টিউশন ও বইপত্র কেনার টাকা দিতো। বৃত্তির নাম ‘কিউনি পাইপলাইন প্রোগ্রাম’। কিসের পাইপলাইন? পিএইচডি করানোর। আমি আমার ম্যাথ প্রফেসরকে বললাম, আমাকে একটা রিকমান্ডেশন দিন। আমি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে চাই। তিনি একটি সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘লিখে দাও আগামী পাঁচ বছর কবিতা লিখবো না’। আমি নাকি তাঁকে একবার বলেছিলাম, গণিত ও কবিতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমার পিএইচডি করা হলো না। অথচ ওই বৃত্তির আওতায় অন্য যারা ছিলেন; তারা সবাই ডক্টরেট করে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। আমি রয়ে গেলাম হাইস্কুলের ম্যাথের শিক্ষক। এখনো আমি মনে করি, গণিত ও কবিতার ভেতরে কোনো পার্থক্য নেই। একইভাবে দুটোতেই মাথা খাটাতে হয়।
জাগো নিউজ: গণিত তো সম্পূর্ণভাবে বাস্তব বা দেখতে পাই কিন্তু কবিতা দেখা যায় না। অনুভবের এমনকি কবিতার লাইন এলহাম আসার মতো, কী বলেন?হাসানআল আব্দুল্লাহ: সাধারণভাবে আমরা গণিতের যা দেখি, সেটি খুবই সামান্য মাত্র। কিন্তু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য এবং যা কিছু চলমান তার পেছনেই গণিত রয়েছে। একটি সহজ কথা বলি, এই যে আমরা পৃথিবীর ওপর দিয়ে হাঁটছি, চলাফেরা করছি কিন্তু মহাকাশে ছিটকে পড়ছি না। এর পেছনে রয়েছে মধ্যাকর্ষণ শক্তি, সেটাতেও আছে গণিত। অনুভবের বিষয় নয় কি! তাছাড়া ছন্দ, অন্ত্যমিল, স্তবক বিন্যাস, পর্ব বিন্যাস সবই তো গণিতের কাজ। কবিতার কাঠামোটিই ধারণ করে আছে গণিত। তাছাড়া হায়ার স্টাডিতে কোনো কিছুর সাথেই কোনো কিছুর তেমন পার্থক্য নেই।
জাগো নিউজ: আপনি মহাকাব্যও লিখেছেন ‘নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ’ নামে। এ সময়ে মহাকাব্য লেখার কারণ কী? এখনকার কবিদের মধ্যে মহাকাব্য নিয়ে তেমন চর্চাও দেখি না। এজন্য মহাকাব্য ও আপনার মহাকাব্য সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি—হাসানআল আব্দুল্লাহ: মহাকাব্য নিয়ে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর ছোট করে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তারপরেও চেষ্টা করছি: ২০০৭ সালে বইটি বের হলে আমি শিবনারায়ণ রায়ের হাতে এককপি দিই। তিনি পাতা উল্টিয়ে অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি ডেরেক ওয়ালকটের মতো বড় কাজ করেছো!’ আমি বলি, ‘ইচ্ছা তো তেমনই ছিল কিন্তু এখন তো মহাকাব্যের সময় নয়!’ তিনি বললেন, ‘রাখো তোমার সময়, শক্তি থাকলেই করা যায়।’ পরে তিনি বইটি পড়ে আমাকে চিঠিতে লেখেন, বইটি তাঁর ভালো লেগেছে। এ নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা আছে। কিন্তু সে সময় তিনি পাননি। আমার দুর্ভাগ্য। এই বইয়ের বিষয় হলো মানুষ ও মহাবিশ্ব। মূল দর্শন হচ্ছে, নারী ও পুরুষ—অর্থাৎ মানুষ আছে বলেই নক্ষত্র আছে। আবার নক্ষত্রের অস্তিত্ব ব্যাতিরেকে মানুষের অস্তিত্ব কল্পনাতীত। গতানুগতিক মহাকাব্যের মতো এখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ নেই, আবার আছেও। যেমন ইরাক যুদ্ধ, যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা ইত্যাদি। আছে খেটে-খাওয়া মানুষের আর্ত-হাহাকারের সাথে মহাবিশ্বের যোগসূত্র তৈরির প্রয়াস। তুমি যদি ডেরেক ওয়ালকটের ‘ওমেরস’ পড়ো, দেখবে সেখানেও যুদ্ধ নেই, আছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মানুষের সংগ্রাম, সমুদ্রের সাথে নিয়মিত লড়াই করে জেলেদের বেঁচে থাকার দিনলিপি। আজকাল টিএস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’কেও কেউ কেউ মহাকাব্য বলেন। সেখানেও দেখবে লন্ডনের বসবাসরত মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামের উপস্থাপন। কিম্বা উইলিয়াম কারলোস উইলিমসের ‘প্যাটারসন’। আর নিকোস কাজানজাকিসের নতুন করে লেখা হোমারের উপাখ্যান, ‘দ্য অডিসি: আ মডার্ন সিক্যুয়াল’। এসবই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ‘নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ’ লেখার জন্য। দীর্ঘ একটা জার্নি ছিল, যেখানে বারোটি বছর ব্যয় করেছি এটা গড়ে তুলতে।
জাগো নিউজ: আপনার লেখালেখি শুরুর গল্প জানতে চাচ্ছি—শুরুর প্রতিবন্ধকতা, সেই সময়ের জার্নি আমাদের জানান...হাসানআল আব্দুল্লাহ: আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। বৈশাখি ঝড় নিয়ে লিখি প্রথম কবিতা। একেবারে গ্রামের পরিবেশে। খড়, গাছের পাতা, ভাঙা ডাল ইত্যাদি উড়ে যাচ্ছিলো, তাই নিয়ে। গৃহশিক্ষকের হেয়ালির কারণে আমার প্রথম কবিতা লেখা। যা হোক, এরপর প্রতিদিনই একটা দুটো ছড়া লিখতাম, আমার মা ছিলেন আমার প্রথম শ্রোতা। ছড়া শুনে তিনি অবাক হতেন, এই অবাক হবার ব্যাপারটি আমাকে উদ্বুদ্ধ করতো। এরপর রাজেন্দ্র কলেজে পড়া অবস্থায় বাজার থেকে কাগজ কিনে খাতা বানিয়ে লেখা শুরু হলো। এটা ছিল আমার লেখার দ্বিতীয় পর্যায়। তৃতীয় পর্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লে পড়া অবস্থায়। তখন বুঝতে পারলাম লিখতে হলে পড়তে হয়। বই কেনা শুরু হলো। কিন্তু পয়সা থাকতো না। টিউশনির পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতাম। এই করে গ্রামে একটা লাইব্রেরিও গড়ে তুলেছিলাম। আমার লেখালেখির চতুর্থ পর্যায় শুরু হয় নিউইয়র্কে পাড়ি জমানোর পর। বই কিনে কিনে তখন ঘর ভরে ফেলেছিলাম। হাতের কাছে বিশ্বের বড় বড় কবিকে পেয়ে কী যে আনন্দ। একদিকে বাংলা কবিতায় বড় বড় কবিদের পড়া, অন্যদিকে বিশ্বকবিতার বড় কবিদের থেকে শেখা। এই তো এভাবেই এগিয়ে যাবার চেষ্টা। আর প্রতিবন্ধকতা! সে তো সব কবির ক্ষেত্রেই থাকে। আমি তো ব্যতিক্রম নই। তুমি যখন বৃত্তের বাইরে যেতে চাইবে, অন্যদের থেকে আলাদা কিছু তৈরি করতে চাইবে, তোমার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবেই। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারার কায়দাটাই শিখেছি বড় কবিদের থেকে।
জাগো নিউজ: তাহলে অনুপ্রেরণা বলতে আপনার বড় কবিরা। এ জন্যই কি উৎসর্গপত্রে দেখি বড় বড় কবিদের নাম?হাসানআল আব্দুল্লাহ: হা হা হা! অবশ্যই বড় কবিদের কাছ থেকে শিখতে হয়, শেখা দরকার। আমি প্রতিনিয়ত শিখেছি, শিখছি। বুদ্ধদেব বসুর থেকে শিখেছি কিভাবে চারপাশে একটি কবিতার জগত তৈরি করতে হয়। সুধীন্দ্রনাথ শিখিয়েছেন কবিতায় গাম্ভীর্য আনার প্রক্রিয়া। শামসুর রাহমানের থেকে শিখেছি কিভাবে যে কোনো বিষয়কে কবিতা করে তোলা যায়। পাবলো নেরুদা শিখিয়েছেন কবিতায় কিভাবে নতুন নতুন গল্প বলা যায়। স্ট্যানলি কিউনিটজ শিখিয়েছেন কতটা মিতব্যয়ী হওয়া যায়। ডেরেক ওয়ালকাটের থেকে নিয়েছি এই সময়ের মহাকাব্যের পাঠ। এত মাত্র দুই একজনের কথা বললাম। বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় বড় কবিদের সংখ্যা তো কম নয়। নজরুল শেখালেন কবিতায় বিদ্রোহ। বলা হয়, উপমাই কবিতা: জীবনানন্দ শেখালেন কী করে উপমার পর উপমা ব্যবহার করে কবিতা লেখা যায়। তবে আমি বন্ধুদেরও অনেক বই উৎসর্গ করেছি। করেছি আত্মীয়দের। তবে মানুষ ও মানুষের জীবনই আমার বড় প্রেরণা।
জাগো নিউজ: আমার একসময় ভালো ক্রিকেটার হওয়ার মতো প্রতিভা ছিল। মায়ের বারণ ও শাসনে হতে পারিনি। এরপর পরিবারের খামখেয়ালি কিংবা অগোছালো ভাবনায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাই যুবক বয়সে। এরপর ভাবনা শুধু সব ছাড়িয়ে কবি হবোই। সব ছাড়িয়েও গেছি। আপনার এরকম কখনো মনে হয়েছে? আপনার মাড়িয়ে আসা স্বপ্ন কিছু ছিল?হাসানআল আব্দুল্লাহ: আমি প্রতিভায় খুব একটা বিশ্বাস করি না। নিয়মিত অনুশীলন করে লক্ষ্যে পৌঁছানোটাকে বড় করে দেখি। আমি সারাজীবন ধরে শুধু কবিতাই লিখতে চেয়েছি, সেটাই করে যাচ্ছি। তবে অতি অল্প বয়সে আমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর একটা পরিকল্পনা ছিল আমার পরিবারের। পরে অবশ্য আর্মি অফিসার হওয়ারও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শব্দ আর ছন্দ যখন মাথার ভেতরে জোরালোভাবে ঢুকে পড়লো, তারপর থেকে আর কোনো দিকে ফিরে তাকানোর চেষ্টা করিনি। জীবিকার জন্য অবশ্য শিক্ষকতাই বেছে নিয়েছিলাম। তা-ও বইয়ের কাছাকাছি থাকতে পারবো বলে। তাছাড়া শিক্ষকতা আমার পছন্দের পেশা।
জাগো নিউজ: কবি কি শুধু অনুশীলনে হওয়া যায়?হাসানআল আব্দুল্লাহ: কল্পনার একটা প্রবল মিশ্রণের তো দরকার আছেই। তবে কবি হওয়ার একেবারে ধরাবাঁধা কোনো প্রক্রিয়া নেই। একটি ভালো কবিতা লিখতে হলে কবিকে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সাথে জানতে হয়: নিজের ভাষার কবিতার ইতিহাস বা বড় কবিদের, সমসাময়িক কবিরা কী লিখছেন—নিজ ভাষা ও অন্য ভাষায়, বিশ্ব কবিতার ইতিহাস। এসবের জন্য একটি বিশাল প্রস্তুতির দরকার আছে। ফলত, অনুশীলনের বিকল্প দেখি না।
জাগো নিউজ: কবির জন্য পাঠক নাকি পাঠকের জন্যই কবি?হাসানআল আব্দুল্লাহ: আমি কখনো পাঠকের কথা মাথায় রেখে কবিতা লিখি না। জ্যা পল সার্ত্রে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সাত বছর বয়সে আমি ঠিক করলাম পাঠকের জন্য লিখবো না। পাঠক কিভাবে পড়বেন, কেন পড়বেন এসব ভেবে লেখা হবে নানারকম প্রশিক্ষণ গাইড, কবিতা নয়। সৃষ্টিশীল কোনো শিল্পই পাঠকের মুখাপেক্ষী নয়।
আরও পড়ুন বই থাকলে সভ্যতা-সংস্কৃতি টিকে থাকবে: শফিক হাসান নিরাশ হয়েছি কিন্তু ভেঙে পড়িনি: অঞ্জন হাসান পবনএসইউ/এএসএম