ভ্রমণ

দুদিনের ছুটিতে কুয়াকাটায় যা যা দেখবেন

দুদিনের ছুটিতে কুয়াকাটায় যা যা দেখবেন

সপ্তাহ শেষে চাকরিজীবীরা পেতে যাচ্ছেন পরপর দুই থেকে তিন দিন ছুটি। এ ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন সাগরকন্যা কুয়াকাটা থেকে। তবে দেরি কেন! ব্যাগপত্র ঘুছিয়ে, ক্যামেরা আর একরাশ উন্মুখ ভালোবাসা নিয়ে এখনই বেরিয়ে পড়ুন বাংলাদেশের দক্ষিণের এ অপার মোহময়তা উপভোগ করতে। কুয়াকাটা, বাংলাদেশের এ সমুদ্রসৈকতে দেখা মিলবে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের।

Advertisement

• আলীপুর মাছ বাজারকুয়াকাটা সৈকতের খুব কাছে, মাত্র ১৫-২০ মিনিটে রিকশা বা মোটরসাইকেল যোগে যাওয়া আলীপুর মাছ বাজারে। এই মাছ বাজারে যেতে চাইলে সকালে যাওয়াই ভালো। সকালে গেলে দেখতে পারবেন ট্রলার থেকে নামানো হচ্ছে ঝুড়ি ঝুড়ি তাজা মাছ। হাঁক-ডাক, দর কষাকষি আর মাছের গন্ধে পুরো বাজার জেগে থাকে।

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, ছবি:সাজেদুর আবেদীন শান্ত

• সূর্যের প্রথম ছোঁয়াসূর্যোদয় দেখতে চাইলে খুব ভোরে অর্থাৎ আলো ফোটার আগেই আপনাকে দাঁড়াতে হবে কুয়াকাটার বিশাল প্রান্তরের সামনে। চোখের সামনে বিস্তৃত কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত–কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বালুকাবেলা, ঢেউয়ের গর্জন আর টাটকা নোনা হাওয়ার গন্ধ।

Advertisement

সূর্য তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে, সমুদ্রের বুকের ওপর দিয়ে যেন এক স্বর্ণালি কার্পেট বিছিয়ে দিচ্ছে। পায়ের নিচে নরম বালি, দূর আকাশের রেখায় মাছ ধরার নৌকা আর তাদের আলতো ভেসে থাকা।

এমন সূর্যোদয় আপনি হয়তো ছবিতে দেখেছেন কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে অনুভব করলে তবেই বুঝবেন, প্রকৃতি কতটা ভরিয়ে দিতে পারে আমাদের মনের ক্যানভাস।

• গঙ্গামতির বনকুয়াকাটার সৈকত ধরে একেবারে পূর্বদিকে হাঁটুন। একটু এগোলেই পা রাখবেন এক রহস্যময় জগতে–গঙ্গামতির বন।

এখানে সবুজ গাছেরা নিজেদের হাত ছড়িয়ে রেখেছে যেন আপনাকে আলিঙ্গন করতে। ঝাউ, কেওড়া, গোলপাতার সারি মিলে তৈরি হয়েছে এক নীরব, প্রাণভরা পথ। পায়ে হেঁটে হেঁটে, কাঁকড়ার ছুটোছুটি দেখতে দেখতে আপনার মনে হবে, আপনি যেন ঢুকে পড়েছেন এক রহস্য উপন্যাসের পাতায়।

Advertisement

কুয়াকাটা যে অংশ থেকে সূর্যোদয় সবচেয়ে ভালো দেখা যায়, তা হলো এই গঙ্গামতির বাঁক। নানান রকম বৃক্ষরাজি ছাড়াও এ জঙ্গলে রয়েছে বিভিন্ন রকম পাখি, বন মোরগ-মুরগি, বানর ইত্যাদি।

ঝাউবনের মাঝে সরু পথ, ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

• ফাতরার বনপশ্চিম দিকে ট্রলারে করে এগোলে দেখা মিলবে আরেক বিস্ময়ের–ফাতরার বন। সমুদ্রের বুক চিরে এগিয়ে চলা ট্রলার আর পানির ওপর ভাসমান ঝাউবনের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। নিঃশব্দ পরিবেশ, মাঝে মাঝে পাখির ডাক আর নৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ–এ যেন প্রকৃতির নিজস্ব এক সিম্ফনি।

ফাতরার বন মূলত সুন্দরবনের অংশ। এখানে আপনি দেখতে পারবেন সুন্দরী, কেওড়া, বাইন, গোলপাতাসহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। তবে শুধু নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়েই আপনি ঢুকতে পারবেন ফাতরার চরে।

বৌদ্ধ বিহার, ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

• মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহারপ্রকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি কুয়াকাটা তার ভেতর লুকিয়ে রেখেছে ধর্মীয় বৈচিত্র্য। মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহার–যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বুদ্ধমূর্তি। রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকেন। এর পাশে রয়েছে একটি বিশাল কুয়া।

বৌদ্ধ বিহারটি সৈকত থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রিকশা, মোটরসাইকেল বা ছোট ভ্যান সহজেই নিয়ে যাবে আপনাকে।

• রাখাইন পল্লিকুয়াকাটার আরেক দর্শনীয় স্থান হলো রাখাইন পল্লি। এখানে রাখাইন মেয়েরা হাতে তৈরি করে তাঁতের কাপড়। এ ছাড়া এখানে পাবেন রাখাইনদের হাতে তৈরি নানান জিনিসপত্র। বার্মিজ আচারসহ নানা স্থানীয় পণ্য।

চাইলে রাখাইন বাজারে হাতের তৈরি ব্যাগ, তাঁতের কাপড়, কাঠের শিল্পকর্ম কিনতে পারেন। বৌদ্ধ বিহারের পাশেই এর অবস্থান।

ফিশ ফ্রাই জোন, ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

• শুঁটকি পল্লিশীতে গেলে এক অনন্য অভিজ্ঞতা পাবেন শুঁটকি পল্লিতে। সমুদ্রের নোনাজল শুকিয়ে, খোলা আকাশের নিচে সারি সারি মাছের স্তূপ–যেখানে বাতাসে ভেসে আসে শুঁটকির ঘ্রাণ।

মাছ শুকানোর পদ্ধতি, গ্রামীণ জীবনযাত্রা আর শ্রমিকদের হাসিমুখ দেখতে চাইলে আপনাকে এখানে আসতেই হবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের ৭ কিলোমিটার পশ্চিম প্রান্তে শুঁটকি পল্লির অবস্থান। এখানে রিকশা বা মোটরসাইকেলে সহজেই পৌঁছানো যায়।

• চর বিজয়কুয়াকাটা ভ্রমণের সব শেষে রওয়ানা দিন চর বিজয়ের দিকে। ট্রলার বা স্পিড বোটে উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে পৌঁছাবেন বিশাল এই চরভূমিতে।

নতুন জন্ম নেওয়া জমি, কাদামাটির গন্ধ, লাল কাঁকড়া, হাজারো পাখির মেলা আর সমুদ্রের অসীম নীল–চর বিজয়ে দাঁড়িয়ে আপনি নিজের ভেতর হারিয়ে যাবেন। চাইলে এখানে ক্যাম্পিং করে নিতে পারেন অনন্য এক অভিজ্ঞতা। স্থানীয় ট্রলারে মাত্র এক ঘণ্টার ভ্রমণেই এখানে পৌছাবেন।

অবকাশ যাপন, ছবি: তানভীর ইসলাম

• দরকারি টিপসকুয়াকাটায় সূর্যোদয় দেখতে চাইলে আগের রাতেই পৌঁছে সৈকতের কাছাকাছি কোনো হোটেলে অবস্থান করুন। যাতে সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতেই সমুদ্রের দিকে যেতে পারেন। চর বিজয় বা গঙ্গামতির বনের মতো জায়গায় যেতে চাইলে গাইডের সহায়তা নেওয়াই ভালো। বিশেষ করে যেসব এলাকা কম পরিচিত বা প্রাকৃতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ট্রলারে ভ্রমণের সময় অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরে নেবেন।

এ ছাড়া ভ্রমণের সময় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক অনেক সময় দুর্বল হতে পারে। তাই প্রয়োজনীয় যোগাযোগ আগেই করে নিন। সূর্যের তাপে বা সমুদ্রের লবণাক্ত হাওয়ায় ত্বক ও শরীরের ক্ষতি এড়াতে হালকা পোশাক, সানগ্লাস ও টুপি সঙ্গে রাখুন।

রাখাইন পল্লিতে ঘোরার সময় তাদের জীবনধারা, ধর্মীয় স্থান বা স্থানীয় পণ্য কেনাকাটার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। সৈকতে সাঁতার কাটার সময় সতর্ক থাকুন এবং সব সময় লাইফগার্ডের নির্দেশনা অনুসরণ করুন।

কুয়াকাটার সৈকতে সূর্যাস্তের সময় সোনালি আলোয় পুরো সমুদ্র ঝলমল করে ওঠে। সেই মুহূর্তের ছবি তুলতে চাইলে ক্যামেরা বা ভালো মানের ফোন ক্যামেরা প্রস্তুত রাখুন। সবশেষে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব আপনারও–কোথাও কোনো ময়লা ফেলে আসবেন না।

• যেভাবে যাবেনপদ্মাসেতু হওয়ার পর বাসে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা আসা সহজ হয়েছে। বাসে এসি ও নন-এসি ৭৫০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা ভাড়ায় সরাসরি আসা যায় কুয়াকাটায়।

তবে লঞ্চে আসতে চাইলে ঢাকার সদরঘাট থেকে পটুয়াখালীর লঞ্চে আসতে হবে। লঞ্চের কেবিন ভাড়া ১ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা। লঞ্চে পটুয়াখালী এসে সেখান থেকে বাসে চড়ে আবার কুয়াকাটা যেতে হবে। পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা বাস ভাড়া ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা।

• যেখানে থাকবেনকুয়াকাটায় ভালো মানের হোটেলের মধ্যে রয়েছে সিকদার রিসোর্ট। এ ছাড়া ইয়ুথ ইন, হোটেল সি গার্ল, সি ভিউ, গ্রেভার ইন, হলিডে হোমসসহ বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। যেগুলোতে ৫০০ থেকে ৩২ হাজার টাকায় থাকা যায়। তবে ছুটির দিনগুলোতে হোটেল পাওয়া কঠিন। পরিবার নিয়ে আসতে চাইলে আগেই হোটেল বুকিং দেওয়া ভালো।

• যা খাবেনকুয়াকাটায় এলে সামুদ্রিক মাছের বিভিন্ন আইটেম খেতে পারেন। সমুদ্রসৈকতের পাশেই রয়েছে বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা। অবশ্যই তাজা মাছ দেখে পছন্দ করে কিনবেন। কেনার আগে দরদাম করে নেবেন। অপরিচিত বা রুচিতে যায় না, এমন খাবার না খাওয়াই ভালো।

এএমপি/এসইউ/জিকেএস