ড.ফোরকান আলীপ্রতি বছর ২২ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘ধরিত্রী দিবস’ বা ‘আর্থ ডে’। পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখাই হলো এই দিনটির মূল লক্ষ্য। পৃথিবীকে রক্ষা করা ও বাসযোগ্য রাখতে বছরের এই দিনটি বিশেষভাবে নির্দিষ্ট।
Advertisement
প্রতিবছরই ধরিত্রী দিবস উদযাপনের জন্য নির্দিষ্ট একটি থিম থাকে। এ বছরের ওয়ার্ল্ড আর্থ ডে বা বিশ্ব ধরিত্রী দিবস ২০২৫-এর থিম ‘আওয়ার পাওয়ার’। এই প্রতিপাদ্যটি সরকার, সংস্থা, ব্যক্তিদের উৎসাহিত করে। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি তিন গুণ অর্জনের লক্ষের পিছনে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট এবং পরিবেশের অবক্ষয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এ দিন নানা কর্মসূচিরও আয়োজন করা হয়।
ধরিত্রী দিবসের ইতিহাস ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল প্রথমবার পালিত হয়েছিল এই দিবস। ১৯৬৯ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে ইউনেস্কো সম্মেলনে শান্তি কর্মী জন ম্যাককনেল পৃথিবী মায়ের সম্মানে একটা দিন উৎসর্গ করতে প্রস্তাব করেন। তবে ১৯৭০-এর ২১ মার্চ উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিনে এই দিনটি উদযাপিত হয়। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর গেলর্ড নেলসন ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল ‘আর্থ ডে’-এর প্রচলন করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীর সহায়তায় এদিন আয়োজন করা হয় প্রথম ধরিত্রী দিবস। প্রায় ২ কোটি মানুষ দিনটি উদ যাপন করেছিলেন। জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমেরিকার প্রচুর মানুষ এদিন রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই থেকেই দিনটির সূত্রপাত। পরিবেশ রক্ষার কথা মাথায় রেখে ১৯৭০ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিভিন্ন আইন। তবুও আজ পৃথিবী সংকটের মুখে।
ধরিত্রী দিবস উদযাপনের কারণজলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই দিনটি পালন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে, পৃথিবীকে সুরক্ষিত ও বাসযোগ্য রাখতে বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালন করা হয় এবং পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পরিবেশ ও জলবায়ুর গুরুত্ব কতখানি, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে বার্তা দেওয়া হয়। এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবী ধ্বংসের মুখোমুখি কারণ ব্যাখ্যা করে সর্তক করছেন। একারণে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়টি সম্প্রতি বিশ্বে গুরুত্ব লাভ করেছে। এসিড বৃষ্টি, গ্রীণ হাউজ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় বিশ্ববাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
Advertisement
স্বাভাবিকভাবে বায়ু মন্ডলে প্রভাব ফেলতে উষ্ণতা বৃদ্ধিকারী গ্যাসগুলোর আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন আগের ধারণার চেয়ে অধিক দ্রুত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। যে কারণে মরুময়তায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত হচ্ছে পৃথিবী। এই পরিবর্তনের ধারায় কখনো সিডর, কখনো সুনামি, কখনো আইলা, কখনো ভূমিকম্প, কখনো অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, বিভিন্ন রকমের রোগ-বালাই দেখা দিচ্ছে দুর্যোগ আকারে। মারা যাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঠের পর মাঠ ফসল। বাড়ছে খাদ্য সংকট। ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে। ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মাথা গোঁজার ঠাঁই। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাব বিশ্বে মরুকরণ একটি অন্যতম সমস্যা। বিশ্বের শুষ্ক ভূমির ৭০ শতাংশ এরই মধ্যে হয়ে পড়েছে মরুকবলিত। এর পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাষণে অব্যবস্থা, লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ আজ অবক্ষয়ের সন্মুখীন। সুতরাং মরুকরণ ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এজন্য প্রয়োজন মরুকরণ বিস্তার রোধ।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে অবক্ষয় প্রক্রিয়াই হচ্ছে মরুকরণ। শুষ্কভূমি পরিবেশগত দিক থেকে খুবই নাজুক। এমন ভূমিই মরুকরণের শিকার হয়। মরুকরণের ফলে ভূমি হারিয়ে ফেলে উৎপাদন ক্ষমতা। হয়ে যায় অনুর্বর। যার ফলে সৃষ্টি হয় খাদ্য সংকট, বাড়ে গরিবের সংখ্যা। তাই খরা, মরুকরণ বিস্তার রোধে প্রয়োজন পরিবেশ সম্মতভাবে, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ন্যায়ানুগ ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় পদ্ধতিতে ভূমির ব্যবহার। মরুকরণের বিরূপ প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি উপলব্ধি করে ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনের পরপরই মরুকরণ সংক্রান্ত আর্ন্তজাতিক কনভেনশন গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
রিও সম্মেলনের এজেন্ডা ২১ এর প্রস্তাবটি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে গৃহীত হয় এবং ইন্টারগভর্ণমেন্টাল নেগোশিয়েটিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মরুকরণ সংক্রান্ত খসড়া কনভেনশন চূড়ান্ত করে। ১৯৯৪ সালের জুনে কনভেনশনের দলিল চূড়ান্ত হয়। এই কনভেনশন ৫০টি দেশ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর ২৬ডিসেম্বর ১৯৯৬ সাল থেকে কার্যকর হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির সহায়তায় পরিচালিত এক জরিপ রিপোর্ট মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে তিন কিলোমিটার পুরু ধোঁয়াশার মেঘ জমেছে। এ মেঘ থেকে ঝড়তে পারে এসিড বৃষ্টি। যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে। ছাই, এসিড, দাবানল, অ্যারোসল অনিয়ন্ত্রিত জ্বালানির ব্যবহার, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও কল-কারখানার বিষাক্ত গ্যাস মিলে বাদামী মেঘের আস্ত্ররণ তৈরি হয়। এ বাদামী মেঘের জন্যই এ এলাকাতে বৃষ্টিপাত দীর্ঘস্থায়ী ও অনিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি উপসাহারীয় আফ্রিকায় খরার কারণে ৩০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। এছাড়া বিশ্বের নানা দেশে জলবায়ুর কুপ্রভাবের ফলে শুরু হয়েছে মরুকরণ।
১৭৫০ সাল থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, কৃষিতে ফলন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার পৃথিবীর পরিবেশের ওপর নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। গত ১০০ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ০.৭৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৫০ থেকে ১.৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা যদি এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে নানা সমস্যার সন্মুখীন হতে হবে আমাদের। এতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের অধিকার, গৃহায়ন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা হুমকির মুখে পড়বে। ভৌগোলিক অবস্থান ও বর্তমানে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের অসহায় শিকারে পরিণত।
Advertisement
এছাড়া পানি নিয়ে ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণ আমাদের দেশে মরুকরণকে ত্বরান্বিত করছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল শুষ্কভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ক্রমান্বয় এই শুষ্কভূমি পরিণত হবে মরুভূমিতে। এরপর আসছে বিভিন্ন বাঁধ প্রসঙ্গ। ভারত যদি বাঁধ দিয়ে পানি এভাবে অব্যাহত রাখে তাহলে আমাদের দেশের উত্তর পূর্বাংশের বিস্তর্ণ অঞ্চল মরুকরণের শিকার হবে। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পানি শূন্য হয়ে পড়বে দেশ। তৈরি হবে নানা ধরনের বিপর্যয়। ভারতের সহযোগিতামূলক মনোভাবই বাংলাদেশের মরুকরণ সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অনেকেই আশংকা করছেন, আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকটা অংশ সমুদ্রগর্ভে বিলিন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীব-বৈচিত্র, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপক‚লবর্তী এলাকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে বন্যা হবে, খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে গিয়ে ক্ষুধা ও গরিবের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে। তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে আমাদের। আমাদের জন্য, আগামী প্রজম্মের স্বার্থে ধরীত্রিকে বদলের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুনলোকজ আনন্দে ফিরে দেখা শেকড়এক সময়ের আধুনিক শহর আজ নিঃসঙ্গ ভুতুড়ে দ্বীপলেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
কেএসকে/জেআইএম