ফিচার

লোকজ আনন্দে ফিরে দেখা শেকড়

লোকজ আনন্দে ফিরে দেখা শেকড়

নতুন সূর্য উঠেছিল লাল-কমলার রঙে রাঙা হয়ে, সঙ্গে ঢাকের বাজনা, মুখরিত রাস্তায় রঙিন পোশাকে হেঁটে চলা মানুষ। তবে ঢাকার বনানীর ‘যাত্রা বিরতি’ যেন ওই দিনের আলাদা এক চিত্রপট। বৈশাখের সকালে এখানে সাজানো হয়েছিল একখণ্ড লোকজ বাংলার আয়োজন। এই আয়োজন ছিল বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য, মাটির গন্ধ আর হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির প্রাণসঞ্চার।

Advertisement

পুতুল নাচ, বাউল সুর আর টিয়ার ভাগ্যগাথাবেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠছিল আয়োজন। কাঠের পুতুল নাচে যখন একপাটি পুতুল গান ধরলো ‘এলো, এলো, এলো রে, পহেলা বৈশাখ’ তখন বাচ্চারা তাল দিচ্ছিল, বড়রাও মোবাইল ফোনে বন্দি করছিল মুহূর্তগুলো। পুতুল চালানো শিল্পী আসমা আক্তার বললেন, ‘আমরা গ্রামের মেলা করতাম, এখন শহরেই ডাক পাই। এমন আয়োজনে অংশ নিতে ভালোই লাগে, হারানো দিনগুলো মনে পড়ে।’

এক কোণে গড়ানো ছিল আলপনার চত্বর, যেখানে অনেক নারী-পুরুষ, শিশুরা গালে হাতে আঁকছে বৈশাখের নানা দেশিও চিত্রকল্প।

অন্যদিকে মাঝখানে বসানো হয়েছিল টিয়া পাখি। সে ঠোঁটে টেনে তুলছিল ভাগ্যলিপির কার্ড। ভাগ্য জানতে এসেছিলেন শৈল্পিক হাসান, এক কর্পোরেট চাকুরিজীবী। হাসতে হাসতে বললেন, ‘কার্ডে লেখা ছিল আপনি প্রেমে পড়তে যাচ্ছেন। আমি তো ভাবলাম, এই পাখি সব জানে কেমন করে!’

Advertisement

পাশেই বসেছিলেন বাউল গায়ক লোকমান হোসেন, হারমোনিয়ামে হাত রেখে সুর তুলে গাইছিলেন লালন, হাসন রাজার গান। দর্শনার্থী সাদিয়া ইসলাম বললেন, ‘এত মেলায় গেছি, কিন্তু এমন করে বাউল গানের মুখোমুখি হইনি কখনো। ভালোই লাগছে দারুণ উপভোগ করছি। আয়োজকদের ধন্যবাদ এতো সুন্দর আয়োজন করার জন্য’।

দর্শনার্থীর চোখে একদিনের গ্রাম‘যাত্রা বিরতি’ একদিনের জন্য যেন হয়ে উঠেছিল একটি ক্ষুদ্র গ্রাম যেখানে ছিল মাটির কলসি সাজানো, ছিল ঢেঁকি, ছিল হাতের কাজের পণ্যের স্টল, এমনকি টুকটুকে লাল শাড়িতে গ্রামের মেয়ের সাজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কয়েকজন তরুণী। আয়োজক পক্ষ জানায়, তাদের উদ্দেশ্যই ছিল ‘বাঙালির হৃদয়ের গ্রামকে নগরের দেয়ালের মাঝে তুলে ধরা।’

আমজাদ ও নিশা নামের এক নবদম্পতি জানালেন, ‘আমরা বৈশাখে বড় শপিং মলেই যেতাম। এবার প্রথম যাত্রা বিরতিতে এলাম। এই পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, গান সবকিছু এমন প্রাণবন্ত যে শহরের ভিড় ভুলে গেছি।’

হারিয়ে যাওয়া বায়োস্কোপের ফিরে আসাবায়োস্কোপ! হ্যাঁ, ঠিক সেই রঙিন বাক্স, যাতে চোখ লাগিয়ে একটার পর একটা দৃশ্য দেখা যায়। আয়োজনের এক কোণে তার ঘিরে ভিড় করেছিল শিশুরা। কার্ডবোর্ডে ছবি লাগানো সেই দৃশ্যপট একদিকে রূপকথা, অন্যদিকে ফিল্মের ঝলক দেখাচ্ছিল। শিশুদের সঙ্গে বাবারা পর্যন্ত চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বিস্ময়ে। আর বায়োস্কোপ যিনি দেখাচ্ছিলেন তার সাজ ছিল আরও রঙিন। রংবেরঙে পোশাকে সং সেজে তিনি যেন হয়ে উঠেছেন আয়োজনের মধ্য মনি।

Advertisement

সংস্কৃতির উৎসব, মানুষের উৎসাহযাত্রা বিরতিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে প্রাণবন্ত আয়োজন চলেছে, তা কেবল বিনোদন নয়, বরং একটি সচেতন সাংস্কৃতিক প্রয়াস।

আয়োজক যাত্রা বাংলাদেশ জানান, ‘আমরা চেয়েছিলাম এমন কিছু করতে, যেখানে লোকজ শিল্পীরা সরাসরি দর্শকের সামনে আসবেন। শহরের শিশুরা জানবে পুতুলনাচ কী, বায়োস্কোপ কীভাবে কাজ করে। এজন্যই এমন এক আয়োজন করা।’

আরও পড়ুনপাতায় কেনা এক টুকরো শৈশবএক সময়ের আধুনিক শহর আজ নিঃসঙ্গ ভুতুড়ে দ্বীপ

কেএসকে/জেআইএম