আন্তর্জাতিক

পুতিনের ‘যুদ্ধবিরতি নাটক’ ও ট্রাম্পের শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ

পুতিনের ‘যুদ্ধবিরতি নাটক’ ও ট্রাম্পের শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ

তিন বছর ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে বাণিজ্যিক জাহাজ ‘দ্য বাল্ড ম্যান’। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের আগের দিন সূর্যমুখী তেলের চালান নিতে এসে এটি আটকে যায় ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে। সেখান থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরেই যুদ্ধক্ষেত্র। দ্য বাল্ড ম্যানের মতো আটকে রয়েছে আরও ২৮টি বিদেশি মালিকানাধীন জাহাজ। এটাই এখন কৃষ্ণসাগরে বাস্তবতা।

Advertisement

চলতি বছরের ২৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা কৃষ্ণসাগরে একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি করাতে পেরেছে। কিন্তু সেই যুদ্ধবিরতির বাস্তব রূপ আজও অধরা। গত ১৮ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, দ্রুত অগ্রগতি না হলে তিনি আলোচনা থেকে সরে যাবেন।

আরও পড়ুন>>

ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে দুই হাজারের বেশি বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন: একে অপরকে দুষছে রাশিয়া-ইউক্রেন

এর মধ্যেই পুতিন ঘোষণা দেন, ইস্টার উপলক্ষে ৩০ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি থাকবে, যা কার্যকর হয় ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা থেকে। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ভাষ্য অনুযায়ী, সেই সময়ের মধ্যেই বহুবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন হয়েছে—যদিও আকাশপথে হামলা কিছুটা কমেছে।

Advertisement

যুদ্ধবিরতির নাটক

এই ‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ যে কেবলই একটি প্রহসন, তা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। কৃষ্ণসাগর ঘিরে এর আগেও রাশিয়া যুদ্ধবিরতির নামে এমন ‘গ্রে জোন’ বা ধোঁয়াশাপূর্ণ কৌশল নিয়েছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, দুই পক্ষ নিরাপদ নৌপরিবহন নিশ্চিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া পরে জানায়, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হলে তারা সমুদ্রপথে যুদ্ধবিরতি মানবে না। ইউক্রেনও চায়, রুশ নৌবাহিনী যেন সাগরের পশ্চিমাংশে না আসে। এই টানাপোড়েন স্পষ্ট করে দেয়, আসলে কোনো চুক্তিই নেই।

২০২২ সালের জুলাইয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় ইউক্রেন আবারও শস্য রপ্তানি শুরু করে, যা ওডেসা, চোর্নোমর্স্ক ও পিভদেন্নিই বন্দরে কার্যকর ছিল। ২০২৩ সালে রাশিয়া সেই চুক্তি বাতিল করলে ইউক্রেন নতুন একটি নৌপথ চালু করে। ইউক্রেনীয় ছোট নৌবাহিনী এবং পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে রুশ নৌবহরকে কৃষ্ণসাগরের পশ্চিমাংশ থেকে হটিয়ে দেওয়া হয়।

বর্তমানে ইউক্রেনীয় নৌবাহিনীর মুখপাত্র দমিত্রো প্লেতেনচুকের ভাষায়, এই সমুদ্র এখন একটি সামরিক ‘গ্রে জোন’—দুই পক্ষের বড় নৌযানই সমুদ্রে নামতে সাহস পাচ্ছে না। নৌ-চলাচল কার্যত বন্ধ, যদিও জাহাজের ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রাখায় তা বোঝা যাচ্ছে না। নিরাপত্তার কারণে তথ্য গোপন থাকলেও এখনো অনেক মালবাহী জাহাজ চলাচল করছে।

Advertisement

পুতিনের ফাঁদ, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ 

২০১৪ সালে ইউক্রেন ক্রিমিয়া ও সেখানে অবস্থিত নৌঘাঁটি হারায়। এরপর ২০১৭ সালে ওখাকিভে মার্কিন বাহিনী একটি নৌঘাঁটি তৈরি করতে শুরু করে, যাকে পুতিন পরে ন্যাটোর হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেন। যুদ্ধ শুরুর দিনগুলোতে ওখাকিভ রুশ হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

আজ ওখাকিভ হয়ে উঠেছে পুতিনের ‘যুদ্ধবিরতির’ কৌশলগত ফাঁদ—যেখানে স্থায়ী শান্তির চেয়ে স্থায়ী অনিশ্চয়তাই মূল লক্ষ্য। শহরের মেয়র সের্হিই বাইচকভ জানান, রুশ ড্রোন হামলায় সকালেও একজন আহত হয়েছেন। শহরটির অর্ধেক মানুষ এখন শরণার্থী।

চলতি মাসের ১৫ ও ১৬ তারিখ তুরস্ক, ইউক্রেন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য কৃষ্ণসাগরের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় বসেছিল। কিন্তু ওডেসাভিত্তিক বিশ্লেষক হান্না শেলেস্ট বলেন, রাশিয়া কোনো শান্তিচুক্তি মানবে—এমন ধারণা অবাস্তব। তার মতে, পুতিন এমন একটি অনির্ধারিত ও বিপজ্জনক সংঘর্ষ চান, যা কখনোই থামবে না। কৃষ্ণসাগর নিয়ে তার ‘গ্রে জোন’ কৌশলের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।

কেএএ/