মতামত

‘অসন্তুষ্ট বিএনপি’ তুষ্ট হবে কীসে?

‘অসন্তুষ্ট বিএনপি’ তুষ্ট হবে কীসে?

একেবারেই সন্তুষ্ট নয় বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ম্যারাথন মিটিং-এর পর তাদের অনুভূতিটা এভাবে স্পষ্ট করলো গণমাধ্যমের সামনে। কেন এমন কঠিন মন্তব্য? আবার প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে যে বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলো, তার সঙ্গে বিএনপির মন্তব্য মিলে না। তাদের কথা-বিএনপিকে আলোচনাকালে সন্তুষ্টই মনে হয়েছে। তার মানে, বৈঠক থেকে বের হয়ে তারা অসন্তুষ্ট হয়ে গেছে। যে মন্তব্য দেখে মনে হতে পারে, সরকার ও বিএনপির মধ্যে গরমিল তৈরি হতে কয়েক মিনিট সময় নিয়েছে মাত্র।

Advertisement

বৈঠকটা হয়েছিল বিএনপির কিছু প্রস্তাব ও দাবি বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল সন্তোষজনক কোনো ফল নিয়ে তারা হয়তো ঘরে ফিরতে পারবেন। আর এই আশা পূরণ হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়াও অনেক স্বস্তিদায়ক হতে পারতো। বাস্তবতা হচ্ছে-সরকারি ভাষ্য যেমনই হোক না কেন, বিএনপির এই অসন্তুষ্টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়াকে আশঙ্কাজনক করে দিচ্ছে।

গত বছর যারা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে সফল হয়েছিল তারা কিন্তু অভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়েই রক্ত-ঘাম ঝরিয়েছিল। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুনিশ্চিত হবে,জনগণ মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারবে,সমৃদ্ধ একটা বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে, এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। কোটা বিরোধী আন্দোলন ১ দফায় পরিণত হবে, কিংবা সরকার গঠন হবে নতুন করে,সরকার কি কি কাজ করবে এমন কোনো পূর্বাভাস তাদের ছিল না। পরিস্থিতির কারণে একসময় আন্দোলনকারীরা কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিল।

আসলে গত বছর এই আন্দোলনের মোড় বদলের আগে হয়তো তারাও ভাবতে পারেনি এমন সাফল্য তারা অর্জন করতে পারবে। এমন কথা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ অনেকেই ইতোমধ্যে দিয়েছেন। সত্য হচ্ছে-অভাবিত এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্রজনতার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণে। সেই ঐক্যে এখন ফাটল ধরছে কেন? এর প্রধান কারণ আন্দোলনের আগে তাদের লক্ষ্য ঠিক করা সম্ভব হয়নি। একইভাবে বলতে হয়, ঠিক করা হয়নি বলে কি সব বাদ দিতে হবে? এক্ষেত্রে বাদ-বাতিল নয়, সংস্কারটাই মূল নিয়ামক হতে পারে। এই সংস্কার বিষয়ে তাই ঐকমত্য অতীব জরুরি বলে অবশ্যই মানতে হবে।

Advertisement

সেটা যে হচ্ছে না তারই প্রমাণ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষনেতাদের বৈঠকের পরবর্তী নেতাদের বক্তব্য। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের অন্যতম বিষয় ছিল সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ এর ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে-দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি দাবি করে আসছে। সরকারের ঘোষণা ভিন্নমুখী। প্রথম অবস্থায় ২০২৫ এর ডিসেম্বর নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় বলা হলেও প্রধান উপদেষ্টা পরবর্তীতে সময়সীমা বেঁধে দেন ২০২৬ এর জুনের মধ্যে হবে নির্বাচন। বিএনপি তাদের চাওয়া সময়সীমা নিয়ে ১৬ এপ্রিল বৈঠকে বসেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। বৈঠক শেষে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল-ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং পরিণামে অর্থনৈতিক দুরবস্থা সৃষ্টি হতে পারে । অসন্তুষ্টির ফল এটুকুতেই বোঝা যায়।

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব নয় কেন? সেই জবাব জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতে ইসলামির বক্তব্য থেকে পাওয়া যায়। তারা জরুরি সংস্কার চায় নির্বাচনের আগে। এ নিয়ে কিন্তু সব দলই ঐক্যবদ্ধ। বিএনপিও এটা চায়। তাহলে সমস্যাটা কোথায়। আসলে জরুরি কোনটা, সেখানেই জট বেঁধেছে। সংস্কারের মধ্যে কি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা অন্তর্ভুক্ত? যদি এটা থাকে তাহলে অবশ্য সহজ পথ দেখা যাচ্ছে না। কারণ জাতীয় নাগরিক পার্টি নিষিদ্ধ চাইলেও প্রধান উপদেষ্টা কিংবা বিএনপি তা চায় না। জামায়াতে ইসলামি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলে। জাতীয় নাগরিক পার্টি প্রধান উপদেষ্টার দল নয়, এটা প্রকাশ্যে বলা হলেও এটা তো সত্য জাতীয় নাগরিক পার্টিই বর্তমান সরকারের স্রষ্টা এবং সমর্থক। সুতরাং সরকার ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে না কি?

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি বৈঠককালে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিচার দ্রুত করার বিষয়ে তারা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনে বিচার করতে গেলে কি ডিসেম্বরের মধ্যে বিচার শেষ করা যাবে? বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা তেমনটা বলে না যে, এত স্বল্পসময়ে বিচার সম্পন্ন করা যাবে। তাহলে বিএনপির ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি পূরণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।

কেউ যেন শক্তিপ্রয়োগের রাজনীতি ধারণ না করেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থা যেন আর না বাড়ে। দেশটা এগিয়ে যাক, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেন কারো হয়ে না কাজ করে, স্থিতিশীল দেশে যেন তারাও ভূমিকা রাখে সেটাই এই মুহূর্তের প্রত্যাশা।

Advertisement

অন্যদিকে সংবিধান বিষয়ে দুটি পক্ষ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। সেই প্রমাণ পাওয়া গেলো ১৮ এপ্রিল বিএনপি ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর। আগেরদিন তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর যেভাবে হতাশা প্রকাশ করেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পরও একই মনোভাব প্রকাশ করেছে। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবের অল্পকিছু ছাড়া অধিকাংশই বিএনপি মানতে নারাজ। তারা সংবিধানের মৌলিক অংশ পরিবর্তনের বিপক্ষে।

বিশ্লেষকরা বলছেন,বিএনপির এমন মানসিকতার পেছনে তাদের দলীয় আদর্শ-নীতি জড়িত। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে ৭২ এর সংবিধান থাকছে না। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সূত্র ধরে যে সংবিধান রচিত হয়েছে, তাকে সরাসরি বাতিল করে দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে নিজ দলের প্রতিষ্ঠাতাকেই অপমান করা হতে পারে। জাতীয় নাগরিক পার্টির চিন্তাভাবনাগুলোই মূলত সংস্কার কমিশন উপস্থাপন করেছে। এই মুহূর্তে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর পক্ষ-বিপক্ষ বিবেচনা করলে দেখা যাবে,পক্ষে আছে জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতে ইসলামি।

এই মুহূর্তে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাকে রাখবে কাকে বাদ দেবে। দলীয় শক্তি তথা জনমত বিবেচনা করলে বিএনপি ও বাকি সব দলকে যদি দুই পাল্লায় রাখা হয়, তাহলে বিএনপির পাল্লাই ভারি হবে। আবার দলের সংখ্যা যদি গোনা হয় সেক্ষেত্রেও বিএনপির মতাবলম্বীদের সংখ্যাই বেশি হবে। তাহলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে কীভাবে? বিকল্প একটা পথ খোলা আছে, তা হচ্ছে সংস্কার প্রশ্নে গণভোট এর আয়োজন। জাতীয় নাগরিক পার্টি কি আগের মতো গণভোট ও গণপরিষদ প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো কথা বলবে? মাত্র দুই তিন মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির শক্তিমত্তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যে কিছু গণমাধ্যমে তাদের ক্ষয়িষ্ণু দল হিসেবে বর্ণনা করতে শুরু করেছে। যাকে কেউ কেউ শৈশবেই নিরাশা হিসেবেও মন্তব্য করছেন। এই অবস্থায় তাদের প্রস্তাবিত সংস্কারের পক্ষে যদি তারা মাঠে নামে, আর বিএনপি একা যদি বিপক্ষে অবস্থান নেয়,তাহলে ফলটা কি হবে বোঝা কঠিন নয়।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নামকাওয়াস্তে ভোটার দিয়ে নির্বাচন করার অবস্থা নেই। রাজনীতির মাঠে কারোই নিরঙ্কুশ আধিপত্য না থাকলেও বিএনপি এগিয়ে এটা যে কেউ স্বীকার করবে। এই বিএনপি যদি গণভোটে না-এর পক্ষে যায় তাহলে জিতবে কে? বোধ করি এর জবাব খুলে বলার প্রয়োজন নেই। পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা সবারই আছে। আর সে কারণেই কি একটি পক্ষ নির্বাচনকে পিছিয়ে নেয়ার দাবি তুলেছে? সব মিলে জরুরি সংস্কার কোনটা সেটুকু নির্ধারণ করা আদৌ সম্ভব হবে কি না সন্দেহ আছে। আর সেই সূত্রে বলা যায়- আগামী জানুয়ারি-জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নাও হতে পারে।

নির্বাচনকে ঝুলিয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করছে কেউ কেউ এমন অভিযোগও রাজনৈতিক মাঠ থেকেই ভেসে আসছে। বিশ্লেষকরা এক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের বক্তব্যকে সামনে আনছেন। এটা কি শুধু সংস্কার বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জড়িত হবে। ইতোমধ্যে আগামী সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। যার একটি হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি’র বক্তব্য অনুযায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। অন্যদিকে সম্প্রতি নাহিদ ইসলাম যে সাবধান বাণী দিয়েছেন সেটিও আমলে নেয়ার মতো। যাকে অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকই হুমকি হিসেবে গণ্য করছেন।

সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে তাই বলতে হবে, কেউ যেন শক্তিপ্রয়োগের রাজনীতি ধারণ না করেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থা যেন আর না বাড়ে। দেশটা এগিয়ে যাক, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেন কারো হয়ে না কাজ করে, স্থিতিশীল দেশে যেন তারাও ভূমিকা রাখে সেটাই এই মুহূর্তের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/জেআইএম