জাতীয়

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, পথে পথে মানুষের ভোগান্তি

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, পথে পথে মানুষের ভোগান্তি

স্কুল ছুটির পর গাড়িতে বাসায় ফিরছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহা। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে এসে বেলা ১১টার দিকে আটকে যায় সোহার গাড়ি। ছয় দফা দাবিতে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তায় পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের ফলে টানা সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় শিশু সোহাকে।

Advertisement

বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সোহার। সে জানায়, স্কুল ছুটি হওয়ার পর ব্যক্তিগত গাড়িতে ফার্মগেটের বাসায় ফিরছিলেন। মাঝপথে সাতরাস্তায় আন্দোলনের কারণে গাড়ি চলছে না। সোহা এক নাগাদে সাড়ে চার ঘণ্টা এক জায়গায় বসে ছিল।

এদিন সকাল ১০টায় ময়মনসিংহ থেকে পরিবারসহ ঢাকার বাসে ওঠেন আবুল কালাম আজাদ। তিনি দুপুর ১টার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনালে আসেন। এরপর সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ঢাকার পোস্তগোলার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আজাদ অটোরিকশায় আটকে ছিলেন তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে। কোনোভাবেই শিক্ষার্থীরা তাদের অটোরিকশা যেতে দিচ্ছিলেন না।

অটোরিকশায় আজাদের কোলে ছিল সাত মাস বয়সী শিশু আরিয়া। সাড়ে ৩টার দিকে আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, সাত মাসের বাচ্চা নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে বেরিয়ে এখনো বাসায় যেতে পারিনি। বাচ্চাটা গরমে কান্নাকাটি করছে। অনেক ছাত্রকে বললাম ছেড়ে দিতে কিন্তু কথা শোনেনি।

Advertisement

শুধু শিশু সোহা কিংবা আবুল কালাম আজাদ নন, বুধবার (১৬ এপ্রিল) তাদের মতো এমন শত শত মানুষকে এভাবে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অনেকেই ক্ষোভ ঝেড়ে বলেছেন, সাধারণ মানুষের প্রতি কী কারও দৃষ্টি নেই? কেউ কী দেখার নেই যে ঢাকায় অচলাবস্থা?

ছয় দফা দাবিতে সকাল ১০টা থেকে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। ফলে ওই সড়কে তৈরি হয় তীব্র যানজট, সেটি ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার প্রায় সব সড়কেই। ভোগান্তিতে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকায় গণপরিবহন থেকে মানুষ হেঁটেই গন্তব্যে ছোটেন। ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীদেরও হাঁটতে দেখা যায়।

বিকেল পৌনে ৪টার দিকে অটোরিকশাচালক আফজাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে এক জায়গায় আটকে পড়ে আছি। সামনের যানবাহনের কোনো নড়চড় নেই। শিক্ষার্থীরা কখন সড়ক থেকে সরে যাবে? জানার কোনো উপায় নেই। বিকল্প কোনো রাস্তা নেই যে চলে যাবো। যানজট নিরসনে কোনো পদক্ষেপও দেখতে পাচ্ছি না। সরকারের লোকজন এসির বাতাস খাচ্ছে আর সাধারণ মানুষের ভোগান্তি পথে পথে।

অটোরিকশাচালক আফজাল বলেন, আমরা তো অসহায়, আমাদের এ ভোগান্তি দেখার মানুষ নেই। সরকারে যারা বসে আছেন, তারা তো জানেন এ আন্দোলনের কথা। তারা তো এসে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। না পারলে প্রশাসনের কোনো প্রতিনিধিকে পাঠাক। সরকারের একজন তো অভিভাবক আছে নাকি! তার দায়িত্ব কী, আমাদের এভাবে ভোগানো? আমি যাত্রী নামিয়ে দিয়েছি। দিনটা তো শেষ! মালিককে আজ জমার টাকার দিতে পারুম না।

Advertisement

আরও পড়ুন সাড়ে ৪ ঘণ্টা পরও সড়ক ছাড়েননি শিক্ষার্থীরা, যানজটে ভোগান্তি চরমে সড়কে নামাজ পড়লেন পলিটেকনিকের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ৬ দাবিতে তেজগাঁও পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ

কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেলের গাড়ি নিয়ে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা চালক মো. মিঠুন জাগো নিউজকে বলেন, সাভার বাইপাইল যাবো। এখানে সাতরাস্তার মোড়েই দুই ঘণ্টা ধরে আটকে আছি। আমরা তো বুঝতে পারছি না কখন ছাড়বে সড়ক। কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমাও জানতে পারছি না। আমরা কারে কী কমু।

আজমেরী পরিবহনের বাসচালক মো. রবি বলেন, বাস ভরা যাত্রী ছিল। অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে সব যাত্রী নেমে গেছেন। আমি আর হেলপার মিলে এখন বসে আছি কতক্ষণে আন্দোলন থামবে, চলে যেতে পারবো এ আশায়। খালি বাস তবুও যেতে দিচ্ছে না।

প্রাইভেটকারচালক শাহরিয়ার হক জানান, এ কেমন আন্দোলন! যেখানে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখা হয় সেটা কোনো ভালো আন্দোলন হয় না। রাস্তায় দেখলাম হাজার হাজার গাড়ি আটকে আছে। জরুরি কাজেও অনেকে বের হয়েছেন কিন্তু কেউ কোনোদিকে যেতে পারছেন না। আমি জরুরি কাজে বের হয়েছিলাম কিন্তু হেঁটেও যেতে পারছি না সঙ্গে থাকা গাড়ির জন্য।

ঢাকায় রাইড শেয়ার করেন পিপুল হাওলাদার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সকাল ৮টায় বের হয়ে মাত্র দুজন যাত্রীকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পেরেছি। এরপর তো দেখছেন কি অবস্থা। তৃতীয় যাত্রীকে নিয়ে তেজগাঁওয়ে ঘণ্টা ধরে বসে আছি। কিন্তু কোনো ছাত্র আমার কথা শুনছে না। কেউ যেতে দিতে চাইছে না। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের দোষ কোথায়?

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ১০টা থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় অবরোধ করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে পুরো ঢাকা। রাজধানীর তেজগাঁও, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার, মগবাজার, এফডিসি মোড়, হাতিরঝিল, গুলশান, মালিবাগ ও মৌচাকসহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র যানজট। শুধু সড়ক নয়, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার ও মহাখালী এলাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ইনকামিং রুটও স্থবির হয়ে যায়।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।'

বুধবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড় আটকে তারা জোহরের নামাজ আদায় করেন। অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী নামাজে অংশ নেন।

এদিকে বিকেল সোয়া ৩টা থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। চারদিকে আটকে থাকা মানুষের ভোগান্তি এতে আরও বেড়ে যায়। সাতরাস্তা মোড়ে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তখনও স্লোগান দিচ্ছিলেন। রোদের সময় ক্রিকেট আর বৃষ্টির সময় বোতলকে ফুটবল বানিয়ে সড়কে খেলতে দেখা যায় তাদের।

ঘটনাস্থলে আসা কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা

ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর নামে কোনো পদ না রাখার ঘোষণাসহ সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোয়াইব আহমাদ খান। তবে শিক্ষার্থীরা চান বাস্তবায়ন। ঘোষণা বা শুধু আশ্বাসে সড়ক অবরোধ তুলে না নিয়ে বরং মহাপরিচালককেই অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা।

বুধবার বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোয়াইব আহমাদ খান। তিনি বলেন, ৩০ শতাংশ পদোন্নতি কোনো বিষয় নেই। তবুও আমরা আপিল করেছি।

এ সময় ঢাকা পলিটেকনিকের অধ্যক্ষ মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সব দাবির সঙ্গে একমত। আমরাও চাই দাবিগুলো পূরণ হোক। দাবি পূরণের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে।

 

পরে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, দাবি পূরণের ঘোষণা দিলেই হবে না। আমাদের লিখিত দিতে হবে। এ প্রতিবেদন লেখা অবধি অধ্যক্ষের কার্যালয়ে রয়েছেন অধিদপ্তরের ডিজি।

সারাদেশে রেলপথ ব্লকেডের ঘোষণা পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের

কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা ও ছয় দফা দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে এবার ঢাকাসহ সারাদেশে রেলপথ ব্লকেডের ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে দিনভর অবস্থান কর্মসূচি শেষে এ ঘোষণা দেন কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী।

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি হলো

১. জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের অবৈধ পদোন্নতির রায় হাইকোর্ট বাতিল করবেন। পাশাপাশি ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদবি পরিবর্তন এবং মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করতে হবে। ২০২১ সালে রাতের আঁধারে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বাতিল এবং সেই বিতর্কিত নিয়োগবিধি অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে।

২. ডিপ্লোমা ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যে কোনো বয়সে ভর্তির সুযোগ বাতিলসহ উন্নত বিশ্বের আদলে চার বছর মেয়াদি মানসম্পন্ন কারিকুলাম নিশ্চিত করে একাডেমিক কার্যক্রম পরবর্তী প্রবিধান থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে সম্পূর্ণ ইংরেজি মাধ্যমে চালু করতে হবে।

৩. উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও সমমানের (দশম গ্রেড) পদ চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং ও মনোটেকনোলজি (সার্ভেয়িং) হতে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও যেসব সরকারি, রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিম্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪. কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় পরিচালক, সহকারী পরিচালক, বোর্ড চেয়ারম্যান, উপসচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব পদে কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত জনবল নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তা আইনানুগভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এ পদগুলোতে অনতিবিলম্বে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ এবং সব শূন্যপদে দক্ষ শিক্ষক ও ল্যাব সহকারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে।

৫. কারিগরি শিক্ষায় বৈষম্য ও দুরবস্থা দূর করার পাশাপাশি দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।

৬. পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগের লক্ষ্যে একটি উন্নতমানের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি, নির্মাণাধীন চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (নড়াইল, নওগাঁ, খাগড়াছড়ি ও ঠাকুরগাঁও) পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক হতে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পাস ও ডুয়েটের আওতাভুক্ত একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আগামী সেশন থেকে শতভাগ সিটে ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

টিটি/এমএএইচ/জিকেএস