মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতির আওতায় বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেই রবিবার (৬ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দেশের মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে।
Advertisement
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং এবং হুন্ডি প্রতিরোধে জোর তৎপরতার ফলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফের উর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে দেশের নানা খাতে যে অস্থিরতা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল; যেভাবে অসংখ্য শিল্প-কারখানা বন্ধ এবং যেভাবে হাজার হাজার শ্রমিক চাকরিচ্যুত এবং তাদের বেতন বকেয়া পড়ে যাচ্ছিলো; যেভাবে এলসি খুলতে সমস্যাসহ ব্যাংকিং চ্যানেলের নানা জটিলতা এবং শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিলেন—তাতে অনেকেরই মনে হয়েছিল যে, দেশের অর্থনীতি বোধ হয় মুখথুবড়ে পড়বে। এমনকি গত নভেম্বরে স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদও বলেছিলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভয়াবহ। তিনি বলেন, লাগামহীন অনিময়ম ও দুনীতিতে পর্যুদস্ত সব খাত।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এর বাইরে সরকারের নানা উদ্যোগে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যতটা দুশ্চিন্তা করা হচ্ছিলো, সম্ভবত সেখানেও বেশ ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। তবে এতকিছুর পরেও দুশ্চিন্তা আছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে।গত পয়লা জানুয়ারি প্রথম আলোর একটি খবরে বলা হয়, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চলমান অস্থিরতার মধ্যে উদ্যোক্তারা বেশ কঠিন সময় পার করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কমেছে, ব্যবসা সম্প্রসারণ থমকে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেড়ে চলা সুদের হার, অবকাঠামোর ঘাটতি, অনিশ্চয়তা—এসবের মধ্যে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কম। আসছে না বিদেশি বিনিয়োগ। আর এর পরিণামে কমছে কর্মসংস্থান।
Advertisement
বাস্তবতা হলো, বিনিয়োগকারীদের প্রথম ও প্রধান কনসার্ন হচ্ছে ভরসা বা নিশ্চয়তা। অনির্বাচিত, অরাজনৈতিক বা অন্তর্বর্তী তথা অস্থায়ী সরকারের আমলে যেহেতু নানাবিধ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকে; বিশেষ করে নির্বাচন কবে হবে; নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে সহিংসতা হবে কি না; সহিংসতা হলে তার প্রভাব শিল্প-কারখানায় কতটা পড়বে; কারা ভোটে জিতবে এবং তাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক কেমন হবে—এরকম নানা চিন্তা ও দুশ্চিন্তা উদ্যোক্তাদের মধ্যে থাকে। যে কারণে অনির্বাচিত তথা অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর আমলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে ভয় পান। যে কারণে বলা হয়, ব্যবসার জন্য মূলধনের চেয়েও বেশি প্রয়োজন ভরসা। যে ভরসা রাষ্ট্রকে দিতে হয়।
ধরা যাক একজন উদ্যোক্তার মূলধন আছে। তার কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাজারও ভালো। রপ্তানির সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল জ্বালানি সংকট; পণ্য পরিবহনের চেইনে অনিয়ম-দুর্নীত ও চাঁদাবাজি ব্যাপক; আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়াটি ব্যবসাবান্ধব নয় এবং রাষ্ট্র এইসব ইস্যুতে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না বা তাদের ভরসা দিচ্ছে না—এরকম পরিস্থিতিতে বিশ্বের কোনো দেশের অর্থনীতি দাঁড়াবে না। উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়বে।
বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ যেহেতু নির্বাচন, ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতি গ্রহণে তারা অনেক সময় আগ্রহ নাও দেখাতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনের মধ্যে দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দিতে পারে। কারণ তারা নিশ্চিত নয় যে নতুন নির্বাচিত সরকার তাদের সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেবে কি না। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সময় প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নতুন আইন ও নীতি প্রণয়ন করতে পারে না, ফলে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা বা নিশ্চয়তা পান না। তাছাড়া নির্বাচনের সময় বা পরবর্তীতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সহিংস বা বিতর্কিত হলে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন। এরকম নানা কারণেই অনির্বাচিত, অরাজনৈতিক বা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সাধারণত বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা দেখা দেয়।
বাংলাদেশে ব্যবসা তথা বিনিয়োগে একটি বড় বাধা হচ্ছে সরকারি অফিসের ঘুষ ও দুর্নীতি। বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ নামে যে সূচক বা তালিকাক্রম প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে, এমনকি আফগানিস্তানেরও (১৬৭) নিচে ছিল বাংলাদেশ।
Advertisement
এরকম বাস্তবতার ভেতরেই রাজধানী ঢাকায় শুরু হলো চারদিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৪০টি দেশের শীর্ষস্থানীয় ৬ শতাধিক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ নিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবী বাংলাদেশকে এক নতুন চোখে দেখবে। ড. ইউনূস বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ায় বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে জানা গেছে।
তাছাড়া অতীতের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা অনির্বাচিত তথা বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতায় আসা সামরিক সরকারগুলোর সঙ্গে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে। এই সরকারটি প্রতিষ্ঠিত মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থানের মুখে। একটি প্রবল পরাক্রমশালী শাসকের পতনের মধ্য দিয়ে। ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন।
তাছাড়া অনির্বাচিত বা অরাজনৈতিক সরকারের আমলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কম হয় বলা হলেও এই ধরনের সরকারের আমলে কিছু সুবিধাও তৈরি হয়। যেমন অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে সাধারণত দলীয় প্রভাব কম থাকে, যা একটি নিরপেক্ষ প্রশাসনিক পরিবেশ তৈরি করে। ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলীয় চাপ বা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ কম থাকে। চাহিদা অনুযায়ী সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যেটা অনেক সময় রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে যদি প্রশাসন দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত থাকে, তবে বিদেশি রাষ্ট্র বা উন্নয়ন সহযোগীরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাতে পারে।
সুতরাং, বিডার আয়োজনে চলমান বিনিয়োগ সম্মেলন সত্যি সত্যিই দেশে বিনিয়োগের নতুন আশার সঞ্চার করবে এবং অন্তর্বর্তী সরকার একটি অস্থায়ী সরকার হলেও তারা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভরসা দেয়ার জন্য এমন কিছু নীতি ও কর্মপদ্ধতি চালু করে যাবে, যার ফলে ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি হবে; বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে তাদের কারখানা স্থাপন করার মধ্য দিয়ে দেশের শ্রমবাজারে একটা ইতিবাচক অনুরণন তৈরি হবে—এটিই প্রত্যাশা।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/এএসএম