নতুন পোশাকের মতো নতুন টাকাও হয়ে উঠেছে ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ। বিশেষ করে শিশুদের ঈদ আনন্দ দ্বিগুণ করে ঈদ সালামির নতুন টাকা। কড়কড়ে নতুন টাকার গন্ধে খরচই করতে চায় না শিশুরা। এমনকি টাকা ভাঁজ করতেও যেন তাদের কষ্ট হয়। বড়রাও ছোটদের খুশির কথা ভেবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন নতুন টাকা সংগ্রহের। এবার এই খুশি থেকে বঞ্চিত ছোট-বড় সবাই।
Advertisement
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এবার বাজারে নতুন নোট ছাড়েনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবছর ঈদ সামনে রেখে সাধারণত ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়া হয়। এবার ঘোষণা দিয়েও শেষ মুহূর্তে নতুন নোট বাজারে ছাড়া স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে গুলিস্তানে ফুটপাতে নতুন নোট বেচাকেনা থেমে নেই। ব্যাংক নোট না ছাড়ায় ব্যাপক দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা। ১০ টাকার একটি নোট কিনতে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৬-৭ টাকা। ফলে সেটা অধিকাংশ মানুষেরই নাগালের বাইরে।
রাজধানীতে স্থায়ী-অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন প্রায় দুই কোটির বেশি মানুষ। এদের বড় একটি অংশ ঈদে গ্রামের বাড়ি যান। ঢাকা ছাড়ার আগে থেকেই তাই শুরু হয় ঈদের আমেজ। বিশেষ করে অফিস-আদালতে ঈদের দু-তিনদিন আগে থেকেই শুরু হয় সালামি দেওয়া-নেওয়া। ছোটরা যারা ঢাকা ছাড়ে তাদেরও অনেকে আগে থেকেই ঈদ সালামি দিয়ে দেন।
নতুন টাকা না পেয়ে এবার ঈদ সালামি দেওয়ার আগ্রহই পাচ্ছি না। বাচ্চারা নতুন টাকা পাবে বলেই সালামি নিতে বেশি আগ্রহ থাকে। তারা টাকার চেয়ে নতুন টাকাকে প্রাধান্য দেয়। অপেক্ষাকৃত একটু বড়দের ডিজিটাল ঈদ সালামি দিচ্ছি।-বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুস সাদিক
Advertisement
কিন্তু পুরোনো ময়লা টাকায় ঈদ সালামি নিয়ে এবার শিশুদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। আবার যারা সালামি দেন তারাও নতুন টাকা বাজারে না থাকায় সালামি দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। অনেকে আবার ডিজিটাল ঈদি বা সালামিতেও ঝুঁকছেন। তবে যে যাই বলুক আসল মজা কড়কড়ে নতুন টাকার গন্ধে- এটি বাক্যে স্বীকার করবেন সবাই।
আরও পড়ুনএবার ঈদে নতুন টাকা ছাড়া হবে না যে কারণেবেশি দামে নতুন টাকা কেনা কি জায়েজ?নতুন ১০ টাকা কিনতে খরচ ১৫ টাকাসাফওয়ান পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায়। একটি করপোরেট হাউজে চাকরি করেন। বছরের দুই ঈদ কাটে গ্রামের বাড়ি বরিশাল। প্রতি বছর ঈদের আগে নিজ পরিবারের শিশুসহ প্রতিবেশীদের জন্য নতুন টাকা সংগ্রহ করেন। এবার কয়েকটি ব্যাংক ঘুরেও মেলাতে পারেননি নতুন টাকা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্য বছর নতুন নোট বাড়ির শিশুদের মাঝে বিতরণ করি। এবার মেলাতে পারিনি, মন খারাপ ছেলেটার। কী করবো জানি না। পুরোনো টাকার কথা শুনে সে (ছেলে) নিতেই চাইলো না।’
একই রকমের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন রবিউল ইসলাম। একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করেন তিনি। এবার ঈদে গ্রামে যেতে পারবেন না। তবে আগেই পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রবিউল জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতি বছর ঈদের আগে বাচ্চাদের নতুন টাকা সালামি হিসেবে দেওয়া হয়। আজ কুড়িগ্রামে পরিবার চলে যাচ্ছে। দুই ছেলেকে সালামি হিসেবে পুরোনো নোট দেওয়ার পর ছোট ছেলে তো টাকা ছুড়ে ফেলে দিলো। প্রথমে বুঝিনি কেন এমন করছে, পরে চিৎকার করে বলছে নতুন টাকা কই? এরপরই বুঝতে পারছি সালামি হিসেবে পুরোনো টাকা তার পছন্দ না।’
ব্যাংকের শাখায় আগের ডিজাইনের যেসব নতুন নোট রয়েছে তা বাজারে না ছেড়ে পুনঃপ্রচলনযোগ্য টাকা দিয়ে সব ধরনের লেনদেন করতে বলা হয়েছে। আগামী মে মাসে নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে আসতে পারে।- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান
Advertisement
একটি বেসরকারি বিশ্বববিদ্যালয়ে কর্মরত আরেফিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন পোশাকের সঙ্গে সালামি হিসেবে বড়দের কাছ থেকে নতুন টাকা নেয় ছোটরা। তাদের ঈদ আনন্দের বড় অংশজুড়ে থাকে নতুন টাকা। আমার ছেলে ও ভাইয়ের সন্তানদের ঈদ সালামি দিতে নতুন টাকা সংগ্রহ করি। এবার কোথাও মেলাতে পারলাম না। বর্তমানে বাজারে ১০, ২০ ও ৫০ টাকার নোটের অবস্থা বেশ খারাপ। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ছেঁড়া-ফাটা। পুরোনো নোটে শিশুরা খুব বেশি খুশি হয় না।’
ঈদ সালামি দেওয়ার ক্ষেত্রেও এবার অনেকের মধ্যে অস্বস্তি দেখা গেছে। কেউ কেউ পুরোনো টাকা সালামি দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ডিজিটাল সালামি (মোবাইল ব্যাংকিং) দিচ্ছেন। পুরোনো টাকার নোট চাহিদামতো মেলানোও কঠিন। নতুন টাকা যখন কেউ নেয় তখন একই টাইপের নোট অনেকগুলো তার কাছে থাকে। এতে বিতরণ করতে সুবিধা হয়। এবার সেখানেও দেখা দিয়েছে সমস্যা।
বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুস সাদিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন টাকা না পেয়ে এবার ঈদ সালামি দেওয়ার আগ্রহই পাচ্ছি না। বাচ্চারা নতুন টাকা পাবে বলেই সালামি নিতে বেশি আগ্রহ থাকে। তারা টাকার চেয়ে নতুন টাকাকে প্রাধান্য দেয়। অপেক্ষাকৃত একটু বড়দের ডিজিটাল ঈদ সালামি দিচ্ছি।’
ঈদের দিনের অভিজ্ঞতাও প্রায় একই। ছোট্ট আলিশবার বয়স মাত্র পাঁচ। সেও নতুন টাকা চেনে। ঈদের নামাজ শেষে তার চাচ্চু সালামি দিতে গেলে নতুন টাকা না পেয়ে মন খারাপ করে। আলিশবার চাচ্চু তানজিল হুদা বলেন, ‘ভাতিজি-ভাতিজাদের প্রতি বছর নতুন টাকা দেই। এবার ব্যাংকে টাকা পাইনি। বাইরে অনেক দাম। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
এবারের ঈদে বাজারে নতুন টাকা বিনিময় করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খোলাবাজারে নতুন টাকার অস্বাভাবিক টান পড়েছে। এ সুযোগে ক্রেতাদের কাছে চড়া দামে নতুন টাকা বিক্রি করছেন ভাসমান দোকানিরা। গুলিস্তান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে নতুন টাকার ভাসমান বিক্রেতারা প্রতি বান্ডিলে (১০০ পিস) ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নিচ্ছেন ক্রেতার কাছ থেকে। যা সাধারণের নাগালের বাইরে।
গুলিস্তানের খোলাবাজারে নতুন নোটের ব্যবসায়ী মো. সুমন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার ব্যাংক থেকে টাকা মিলবে না। এতে দাম বেশি, ক্রেতাও কম আসছেন। আমাদের কিছুই করার নেই। সরবরাহ বেশি থাকলে দরদাম করে বিক্রি করা যেত।’
এ বাজারে নতুন টাকা সংগ্রহ করতে এসেছেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই গ্রামে যাই নতুন নোট নিয়ে। ছোটদের ঈদ সালামিতে নতুন নোট দেওয়া মানে তাদের জন্য বাড়তি আনন্দ। এবার আর সেই সুযোগ হচ্ছে না। দাম অনেক চড়া। খুব কম পরিমাণ নোট সংগ্রহ করলাম।’
প্রতিবছরের এবারও ঈদুল ফিতরের আগে নতুন টাকা বিনিময়ের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৯ মার্চ থেকে নোট বিনিময়ের কথা ছিল। এ সংক্রান্ত নির্দেশনাও দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু হঠাৎ করেই সেটা স্থগিত করা হয়।
মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বাদ দিয়ে নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে আনতে না পারায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জাগো নিউজকে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংকের শাখায় আগের ডিজাইনের যেসব নতুন নোট রয়েছে তা বাজারে না ছেড়ে পুনঃপ্রচলনযোগ্য টাকা দিয়ে সব ধরনের লেনদেন করতে বলা হয়েছে। আগামী মে মাসে নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে আসতে পারে।’
ইএআর/এএসএ/জেআইএম