খেলাধুলা

‘সিপিআর দেবো কিনা, তখন সিদ্ধান্ত নিতে সাহসের প্রয়োজন ছিল’

‘সিপিআর দেবো কিনা, তখন সিদ্ধান্ত নিতে সাহসের প্রয়োজন ছিল’

বিকেএসপিতে যখন তামিম ইকবাল হার্ট অ্যাটাক করেন, তখন হাসপাতালে নিতে নিতে অ্যাম্বুলেন্সেই তামিম ইকবালকে সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) দেন মোহামেডান ক্লাবের ট্রেইনার ইয়াকুব চৌধুরী ডালিম। বলা হচ্ছে, তামিম ইকবালকে ওই সময় যদি সঠিকভাবে সিপিআর দেওয়া না হতো, তাহলে হয়তো বাঁচানোও যেতো না তাকে। ইয়াকুব চৌধুরীর তাৎক্ষণিক সিপিআর দেওয়ার সিদ্ধান্তে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হতে গিয়েও হয়নি। ম্যানুয়ালি হার্টের ধমনিতে রক্ত সঞ্চালনের কাজ ফিরে আসে।

Advertisement

ইয়াকুব চৌধুরীই মূলত তামিমের জীবন ফেরানোর প্রাথমিক হিরো। সবাই প্রশংসা করছে তার। এমনকি তামিম ইকবালও তার পোস্টে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন ইয়াকুব চৌধুরী ডালিমের। জাগোনিউজের সঙ্গে আলাপে তামিমের হার্ট অ্যাটাকের সময়কার চিত্র সুচারুরূপে তুলে ধরেছেন। জানিয়েছেন, কিভাবে সিপিআর দিয়েছেন। তখনকার পরিস্থিতি কি ছিল!

ইয়াকুব চৌধুরী ডালিমের সঙ্গে জাগোনিউজের কথোপকথন তুলে ধরা হলো পাঠকদের উদ্দেশ্যে...

প্রশ্ন: মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে ট্রেইনার হিসেবে কবে থেকে কাজ শুরু করেছেন?

Advertisement

ইয়াকুব চৌধুরী ডালিম: ২০১৩ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে আছি।

প্রশ্ন: ট্রেইনার হিসেবে ক্যারিয়ার কবে থেকে শুরু, আর কোন কোন ক্লাবের সঙ্গে কাজ করেছেন।

ডালিম: ২০১১ সালে বিসিবিতে ট্রেইনার হিসেবে কাজ করতাম। ২০১২ সালে গাজী ট্যাংকের (বর্তমানে লিজেন্ড অব রুপগঞ্জ) প্রিমিয়ার লিগে প্রথম ট্রেইনার হিসেবে কাজ শুরু করি। এর আগে ক্লাব ক্রিকেটে ট্রেইনার প্রথার খুব একটা প্রচলন ছিল না। আমরাই প্রথম ক্লাব ক্রিকেটে ট্রেইনার প্রথা শুরু করি। ২০১৩ সালে যোগ দিই মোহামেডানে।

প্রশ্ন: হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে সিপিআর দেয়াটা কী আপনাদের ট্রেনিংয়ের অংশ ছিল? নাকি নিজে থেকে জানতেন?

Advertisement

ডালিম: এটা আমাদের ট্রেনিংয়ের অংশ ছিল। মূলত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই ট্রেইনারদের প্রাথমিক চিকিৎসাসহ (ফার্স্ট এইড) সিপিআর জানা বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশে হয়তো এর প্রচলন কম। তবে আমরা যারা বোর্ডে কাজ করতাম, তারা ব্যক্তিগতভাবে শিখে নিয়েছি। এরপর ২০১৯ সালে বিসিবিই প্রাথমিক চিকিৎসা, সিপিআরসহ নানা বিষয় নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল। সুইডেনের একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এই কর্মশালা পরিচালনা হয়। আমরা ওখান থেকেই ভালোভাবে শিখেছি। প্রশ্ন: তামিম ইকবাল যখন হার্ট অ্যাটাক করেন, তখন হুট করে আপনার মাথায় সিপিআর দেয়ার চিন্তা এসেছিল নাকি কেউ বলেছিলো?

ডালিম: আসলে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্পোর্টস সাইন্সের ওপর। গ্রাজুয়েশন এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনও করেছি স্পোর্টস সায়েন্স নিয়ে। এ কারণে আমার আগে থেকে ধারণা ছিল এ বিষয়ে। তবুও তামিম যখন হার্ট অ্যাটাক করে, তখন বিষয়টা নিশ্চিত হতে চেয়েছি যে, আসলেই হার্ট অ্যাটাক করেছে নাকি অন্যকিছু।

এসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক ডায়গনোসিসটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা করার পর যখন তার পালস পাচ্ছিলাম না, অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোও যখন কাজ করছিল না, তখন বুঝে গেছি বড় ধরনের অ্যাটাক (ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক) হয়েছে। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই আমি প্রাথমিক ডায়াগনোসিসটা শেষ করি এবং সিপিআর শুরু করে দিই।

প্রশ্ন: ওই সময়কার পরিস্থিতিটা যদি একটু বলতেন?

ডালিম: আমরা দ্রুত তামিমকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়েছিলাম কেপিজে হাসপাতালে নেয়ার জন্য। তখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই হাসপাতালে নেয়াছাড়া উপায়ও ছল না। আর অ্যাম্বুলেন্সে তামিমের সঙ্গে কোয়ালিফায়েড লোক বলতে শুধু আমিই ছিলাম। সঙ্গে অন্য যারা তারা ছিল সাপোর্ট স্টাফ। অ্যাম্বুলেন্সে উঠেই সিপিআর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তবে, তামিম যেহেতু বাংলাদেশের ক্রিকেটের ওয়ান অব দ্য বেস্ট আইকন, তাকে সিপিআর দেবো কি দেবো না, এ সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও ছিল সাহসের ব্যাপার। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে, দ্বিধা না করে সাহস করে ফেললাম। কারণ, সিপিআর তো একটা মেডিকেল মেথড। যেটা আমার জানা ছিল। আমি সেটা দেয়া শুরু করি।

প্রশ্ন: তামিমের অবস্থা তখন কেমন ছিল?

ডালিম: তামিমের অবস্থা তো তখন একবারেই নাই হয়ে গিয়েছিল। কেনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টোটালি কোনো রেসপন্স করছিল না। অ্যাম্বুলেন্সের সিটের ওপর যেন একটা মৃতদেহের মত পড়ে ছিল।

প্রশ্ন: আপনি নিশ্চিত ছিলেন, সিপিআর দিলে কাজ হতে পারে?

ডালিম: নিশ্চিত তো বলা যায় না। মেডিকেল সায়েন্সে এ ধরনের রোগীকে কখনোই বলা যায় না যে চিকিৎসা দিয়ে নিশ্চিতভাবে সারিয়ে তোলা যাবে। মেডিকেল সায়েন্সে বলা হয়, হয়তো বাঁচানো সম্ভব। আর তার যে অবস্থা হয়েছিলো, এটা তো সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার। সবচেয়ে বড় বিষয়, সে সম্পূর্ণ আল্লাহর রহমত পেয়েছিলো। একজন মুসলিম হিসেবে অন্তত আমি এটা বিশ্বাস করি।

প্রশ্ন: এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন? কখনো সিপিআর দিতে হয়েছিলো কাউকে?

ডালিম: না, হার্ট রিলেডেটে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি। তবে অন্য রিলেটেড অনেক সময় অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। যেমন বিকেএসপির এক খেলোয়াড়ের সমস্যা হয়েছিল। কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পায়ের অংশে বড় ধরনের আঘাত পায় এবং প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিলো। ওই সময় ফাস্ট এইড জানা থাকায় তাকে হেল্প করতে পেরেছি। হজে গিয়ে একটা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। কাফেলার একজন মহিলা হিটস্ট্রোক করেছিল। তখন এ নিয়ে যেটা করা দরকার, তাৎক্ষণিক সেই ট্রিটমেন্ট দিয়েছি। এমন অসংখ্যা ছোট-খাট ঘটনা আছে। তবে, হার্ট রিলেটেড এই প্রথম।

প্রশ্ন: ২২ মিনিট টানা সিপিআর দিয়ে গেছেন, সেটা অ্যাম্বুলেন্সে নাকি হাসপাতালে যাওয়ার পর? অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?

ডালিম: না ২২ মিনিট না। আমি সিপিআর দিয়েছি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে। সেটা ৮ থেকে ১০ মিনিট হবে। অর্থাৎ হাসপাতালে যাওয়া পর্যন্ত। ২২মিনিটের বিষয়টা সম্ভবত হাসপাতালে যাওয়ার পর, তারা এডভান্স সিপিআর দিয়েছিল। কিংবা আরও যা যা করা দরকার তা করেছিলো।

প্রশ্ন: যাই হোক, আপনি তো সফল। তামিম বেঁচে ফিরেছেন। ডাক্তারদের পাশাপাশি আপনাকে সবাই কৃতিত্ব দিচ্ছেন। এমনকি সবাই বলছেন, আপনি যদি সিপিআর না দিতেন, তাহলে হয়তো তামিমকে বাঁচানোই যে তো না। তামিমও কাল রাতে ফেসবুক পোস্টে আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?

ডালিম: আসলে, আমাকে যখন মিনহাজ প্রথম লিংক (তামিমের পোস্টের) পাঠায়, তামিমের সঙ্গে তো অনেক বছর ধরে কাজ করি। তিনি আমার টিমমেট এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা একজন আইকন। তার কিছু হলে আমার থেকে খারাপ আর কারো বেশি লাগতো না। কারণ, ওই মুহূর্তে তার সামনে আমিই ছিলাম। আমার দায়িত্ব ছিল তাৎক্ষণিক কিছু করার। যা জানা ছিল, সে অনুযায়ী সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। আল্লাহ তার হায়াত রেখেছেন, ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি হয়তো একটা ছোট উসিলা ছিলাম।

তো, তামিম যখন তার পোস্টে আমার নাম লিখেছে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে, সেটা পড়ে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে। আমি তো সাধারণ একজন মানুষ। তামিম অনেক বড় মাপের একজন মানুষ। অনেক বড় তারকা। তার কাছ থেকে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে- এটা তো লাখ টাকা-কোটি টাকা দিয়েও কিনতে পারবো না।

সিপিআর ও ফাস্ট এইড সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর সার্টিফিকেট গ্রহণ (নীল গেঞ্জি পরিহিত)

আমি তার জন্য ওই সময় চেষ্টা করেছি, তাল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ভালো লাগা, সবচেয়ে বড় স্যাটিসফেকশন। আমি মনে করি, এটা অনেক বড় একটি ভালো কাজ। এ ধরনের ভালো কাজ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আর তামিমের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পর মনে হলো, হয়তো আমি কিছু করতে পেরেছি, সামান্য হলেও অবদান রাখতে পেরেছি।

তামিম যখন হার্ট অ্যাটাক করে তখন তো সেখানে টিটু (তারিকুল ইসলাম টিটু) ভাই, দেবু দা (দেবব্রত পাল) ছিল, শিপন ভাই (সাজ্জাদ হোসেন শিপন) ছিল। তাদের চেয়ে তখন আমার দায়িত্বটা ছিল বেশি। আমাকেই কিছু করতে হবে, এ তাড়না ভেতর থেকে এসেছিল। এ কারণে আমি চেষ্টা করেছি। বাকিটা, আল্লাহর রহমত ছিল, তাই তামিম জীবন ফিরে পেয়েছেন।

প্রশ্ন: তামিমের হার্ট অ্যাটাকের খবর পরিবারকে জানিয়েছেন কিভাবে?

ডালিম: তামিমের বড় ভাই নাফিস ইকবালের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। তার সাথে হৃদ্যতা আমার অনেক বেশি। তো অন্যদের কাছ থেকে জেনে তিনি আমাকে বার বার ফোন করছিলেন। কারণ, অ্যাম্বলেন্সে তামিমের সঙ্গে ছিলাম আমি। আমার তখন মাথায় কাজ করছিলো, নাফিস ভাইও তো গত বছর স্ট্রোক করেছিলেন। এখন তাকে যদি তামিমের প্রকৃত অবস্থা বলি, তাহলে হয়তো তারও নেগেটিভ কিছু হতে পারে। এ কারণে, তাকে স্বান্তনা দিয়েছি। বলেছি, খুব খারাপ কিছু না, ভালো হয়ে যাবে।

এরপর হাসপাতালে যখন নেয়া হয়, তখন অবস্থা এমন যে প্রকৃত অবস্থা তার পরিবারকে না জানানোও উচিৎ হবে না। তখন নাফিস ভাইকে বলেছি, আপনাদেরকে একটা কথাই বলবো, যে আল্লাহ আল্লাহ করেন। আল্লাহ চাইলে জীবনি ফিরিয়ে দিতে পারেন।

হাসপাতালে গিয়ে তার ভর্তির কাগজপত্রে আমিই প্রথম স্বাক্ষর দিই। এরপর যখন ক্যাথে ল্যাবে তার হার্টে রিং পরানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়, তখন অনাপত্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন দেবু দা (দেবব্রত পাল)। আমরা সবাই তখন তামিমের পাশে ক্যাথে ল্যাবেই ছিলাম। এরপর নাফিস ভাই, তার মা এবং আয়েশা ভাবি (তামিমের স্ত্রী) হাসপাতালে আসেন।

প্রশ্ন: সিপিআর শেখা কতটা জরুরি? এটা শেখা কী খুব কঠিন কিছু?

ডালিম: সিপিআর শেখা কঠিন কিছু না। শুধু রোগির কন্ডিশন বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে টেকনিক অবলম্বন করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে একটাই টেকনিক- দেখুন, শুনুন এবং বুঝুন। এই বিষয়টা (সিপিআর) আপনারও শেখা উচিত। এবং আপনার আশপাশে যারা যারা আছে তাদেরকেও শিখতে বলুন। এসব শিখতে রকেট সায়েন্স জানার রদাকার নাই। আর সবচেয়ে জরুরি হলো, রোগীর তাৎক্ষণিক ডায়গনসিস করা।

কারণ, হয়তো দেখা গেলো রোগী কোনো কারণে সেন্সলেস হয়ে গেছে। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক নয়। এ সময় সিপিআর দিলে তো হিতে বিপরীত হবে। এ কারণে রোগীর অবস্থা বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ। ওটার জন্য ট্রেনিং ও পড়াশোনার দরকার হয়। সবার প্রতি রিকেুয়েস্ট থাকবে, সবারই এ বিষয় শেখা উচিত এবং সেঙ্গ ফার্স্ট এইডও।

প্রশ্ন: আপনি কি এ বিষয়ে একটা ট্রেইনিং আয়োজন করতে চান?

ডালিম: আসলে এ বিষয়টা তো একটি মেডিকেল ফাংশন। এ নিয়ে কোর্স আয়োজন করবে মেডিকেলের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষরা। তবে, ফান্ডামেন্টাল কোনো কর্মশালার আয়োজন করলে সেখাতে শেখাতে পারি, স্রেফ জনসচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে।

প্রশ্ন: জাগোনিউজকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ

ডালিম: আপানাদেরকেও ধন্যবাদ।