প্রবাস

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্ভাবনা এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্ভাবনা এবং বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা

জাতিসংঘের মহাসচিব এমন একজন নেতা, যিনি কেবল একটি সংস্থা পরিচালনা করেন না বরং বৈশ্বিক শান্তি, মানবিক মূল্যবোধ এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে কাজ করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিঃসন্দেহে সেই ব্যক্তি, যিনি তার কাজ ও দর্শনের মাধ্যমে বহু আগেই বিশ্ববাসীর আস্থা অর্জন করেছেন। তিনি এমন একজন নেতা, যিনি ক্ষমতা নয়, মানুষের কল্যাণকেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন।

Advertisement

বিশ্ব আজ গভীর সংকটে নিমজ্জিত। যুদ্ধ, দারিদ্র্য, বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, শরণার্থী সমস্যা এবং দুর্নীতির করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত মানবসভ্যতা। জাতিসংঘের মতো সংস্থার প্রয়োজন কখনো এত তীব্রভাবে অনুভূত হয়নি। কিন্তু এই সংস্থার কার্যকারিতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ—অর্থবিত্ত, রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে এটি তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘকে যদি তার প্রকৃত দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হয়, তবে এমন একজন নেতার প্রয়োজন, যিনি দূরদর্শী, নিরপেক্ষ, মানবিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহসী। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই নেতা।

তিনি শুধু একজন নোবেল বিজয়ী নন বরং দারিদ্র্য বিমোচনের একটি নতুন দর্শন প্রতিষ্ঠার কারিগর। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে দেখিয়েছেন, কেবল দাতা সংস্থা বা সরকারি উদ্যোগই নয় বরং সাধারণ মানুষও নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতে পারে যদি তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হয়। তিনি এমন এক বিশ্ব কল্পনা করেন, যেখানে কেউ দারিদ্র্যের অভিশাপে জর্জরিত থাকবে না। জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে তিনি এই দর্শনকে আরও বিস্তৃত পরিসরে প্রয়োগ করতে পারেন, যেখানে অর্থনৈতিক অসমতা হ্রাস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন হবে বৈশ্বিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি।

তার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তিনি মানুষকে বিশ্বাস করেন এবং মানুষ তাকে বিশ্বাস করে। রাষ্ট্রনেতারা তাকে সম্মান করেন, সাধারণ মানুষ তার কথায় আশার আলো দেখতে পান। তার প্রতি এই বিশ্বাস শুধু তার কাজের ফল নয় বরং তার সততা, নৈতিকতা এবং গভীর মানবিক মূল্যবোধের পরিচায়ক। তিনি কখনো ক্ষমতার মোহে পরিচালিত হননি বরং ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও শান্তিকেই তার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

Advertisement

কূটনৈতিক দক্ষতার দিক থেকে তিনি অনন্য। তিনি কখনো আগ্রাসী নন, কিন্তু তার উপস্থিতিই সমস্যার সমাধানের পথ খুলে দেয়। কল্পনা করুন, সিরিয়া বা গাজার কোনো শরণার্থী শিবিরে তিনি যখন প্রবেশ করবেন, তখন কী হবে? মানুষ তাকে কেবল একজন নেতা হিসেবে নয় বরং একজন সহমর্মী, এক আশার প্রতীক হিসেবে দেখবে। আফ্রিকার কোনো খরাক্রান্ত গ্রামে, যেখানে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে, তিনি সেখানে গেলে শুধু ত্রাণ নিয়ে যাবেন না বরং একটি টেকসই অর্থনৈতিক মডেল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পথ তৈরি করবে।

তার ভাষাগত দক্ষতাও তাকে আরও যোগ্য করে তুলেছে। ইংরেজিতে তার সাবলীলতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাকে স্পষ্টভাবে নিজের কথা বলার সুযোগ দিয়েছে। তিনি যেভাবে নীতিগত অবস্থান নেন, তা শুধু ভাষাগত দক্ষতার কারণেই নয় বরং তিনি বিশ্বাস করেন যে সত্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা উচিত।

বাংলাদেশের বর্তমান সংকটেও তিনি যে দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন, তা তাকে আরও যোগ্য প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। দেশে যখন রাজনৈতিক সংঘাত ও অনিশ্চয়তা চরমে, তখন তিনি শান্ত, দৃঢ় এবং নীতিগত অবস্থান নিয়ে সংকট মোকাবিলা করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে, তার নেতৃত্ব কেবল তাত্ত্বিক নয়, বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচনে কেবল অভিজ্ঞতা নয় বরং নৈতিকতা ও নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ড. ইউনূস কেবল জাতিসংঘের নেতৃত্ব দিতে পারবেন না বরং এই সংস্থাটিকে তার আদর্শিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। তার নেতৃত্বে জাতিসংঘ আরও স্বচ্ছ, গণমুখী এবং কার্যকর সংস্থা হয়ে উঠতে পারে, যা সত্যিকারের বিশ্বশান্তি ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাবে।

Advertisement

আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যখন জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলোর প্রয়োজন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু এটি তখনই কার্যকর হবে, যখন এর নেতৃত্বে একজন সত্যিকারের বিশ্বনাগরিক থাকবে, যিনি ক্ষমতা নয়, মানবতার সেবাকে অগ্রাধিকার দেবেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই ব্যক্তি, যিনি শুধু জাতিসংঘের নেতৃত্বই দিতে পারেন না বরং এই সংস্থাটিকে তার আসল উদ্দেশ্যের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। তিনি কেবল একজন সম্ভাব্য প্রার্থী নন বরং এই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নেতা।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/জিকেএস