সাহিত্য

কবির সঙ্গে একরাত

অফিস থেকে বাসায় ফিরে ‘মেহের নিগার’ দেখে ঘুমাতে বেশ রাত হলো। ফেরদাউস ও মৌসুমীর অভিনয় ভালো লেগেছে। এরআগেও বেশকয়েকবার সিনেমাটা দেখেছি। যতই দেখি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। যেন নজরুলেরই প্রতিচ্ছবি দেখছি। অফিস শেষে বাসায় ফিরে রাত জেগে সিনেমা দেখা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। সিনেমা শেষে এর সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ। কাহিনিকারের শিল্পবোধ নিয়েও অনুসন্ধান চলতে থাকে। কিন্তু আজ কিছুই বলার নেই। কাহিনিকার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাই চোখে ঘুম থাকলেও কাহিনির রেশটা মগজের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। শুয়ে শুয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এতো রাতে আবার কে এলো? কানে শব্দ আসলেও উঠে গিয়ে দরজা খুলতে প্রবৃত্তি হচ্ছে না। শব্দটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ঢুলু ঢুলু চোখে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই চোখ ছানাবড়া। আমি ভুল দেখছি নাতো? চোখ কচলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকালাম।- আপনি?- হ্যা, আমি?- না মানে...। আপনি তো সেই কবেই...?- বিশ্বাস হচ্ছে না?- কীভাবে সম্ভব?- হা-হা-হা। বিশ্বাস না হওয়ারই কথা। তবে তুমি কি জানো না, আমি পাঠকের মাঝে বিরাজমান। ঘুরে-ফিরে পাঠকের কাছেই আসি। কারণ পাঠকই আমার প্রাণ। সেই প্রাণের কাছে এলে আবার প্রাণ ফিরে পাই।- তাও কি সম্ভব?- তবে কি অস্বীকার করছো আমাকে?- না, সে সাহস বা ক্ষমতা আমার নেই। আপনি সর্বত্র বিরাজমান। আমার বইয়ের তাকে। লেখার খাতায়।- তা জানি। তোমাকে চমকে দেয়ার জন্যই আমার আগমন। তবে বিশেষ কিছু প্রয়োজনও ছিলো।- আমার মতো নগণ্য মানুষের কাছে কী এমন প্রয়োজন আপনার? সেকি দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন!তিনি ভেতরে এলেন। আমি কম্পমান হাতে আস্তে করে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঘরে আর কেউ ছিলো না। অবিবাহিত মানুষ আমি। বাড়ির ছাদের এক কোণায় এই ছোট্ট ঘরে আমার বসবাস। সে বাড়ির মালিকের দয়ায়। বাড়ির মালিকও লেখক মানুষ। তাই ক্ষুদ্র এ লেখকের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ।এদিক-সেদিক তাকিয়ে আমার পুরো কক্ষটা এক নজর দেখে নিলেন। মেঝেতে পাতানো বিছানা। খাট নেই। একটা টেবিল আর চেয়ার। চেয়ারটা এগিয়ে দিলাম বসার জন্য। আমার বিছানার পাশেই ফ্লর থেকে জানালার কার্নিশ পর্যন্ত সাজানো বই। মাঝারি ধরনের একটা বইয়ের তাক। জায়গা না থাকায় বাকি বইগুলো ছড়ানো-ছিটানো। তিনি কেন যেন একটু হাসলেন। আমি বিব্রত হলাম। ভাবলাম আমার দৈন্যদশা দেখে হাসছেন।- হাসছেন কেন?- তোমাকে চমকে দিলাম, তাই। এতো রাতে এলাম বলে রাগ করোনি তো?- ছি-ছি! সেকি বলেন? রাগ করবো কেন? এ তো আমার সৌভাগ্য। আপনার মতো দ্রোহ-প্রেম-সাম্যের কবি আমার ঘরে। নিজের কাছে অবাক লাগে। আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো?- না, যত বড় ভাবছো, তত বড় নই আমি। আমার এতো অভিধা সেতো তোমাদেরই দান। আমি সামান্য নজরুল। চিরকাল দুখু মিয়া।- সাহিত্যের সব শাখায় আপনার অবাধ বিচরণই আপনাকে মহৎ করে তুলেছে।- সব শাখা আর কই? যা কিছু কবিতা আর গানে। গল্প-উপন্যাস কোনোরকম। প্রবন্ধে চেষ্টা করেছি। থাক সে কথা, আমি স্বপ্নভঙের হতাশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি।- আমার কাছে? আমি কী করতে পারি আপনার জন্য?- তুমি বা তোমরাই পারবে। তোমাদের হাতেই আগামীর বাংলাদেশ। তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ষোলো কোটি মুখ।- আমায় খুলে বলুন।- অভাগা দেশটির মুখপানে তাকিয়েছো কখনো?- রোজই তো দেখি। - ভুল দেখ। কিংবা যা দেখো, তা অনুধাবন করো না। তা না হলে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে কী করে? তোমরা প্রতিবাদী হতে ভয় পাও। আমিতো বৃটিশদের বিরুদ্ধে কলম ধরে জেল খেটেছি। তাতে কী এমন ক্ষতি হয়েছে আমার? কবিরা কি মুখ বুজে সহ্য করবে? শুধু কলমের ভাষায় প্রতিবাদ করবে? কবিরও তো হাত আছে রোধ করবার। শক্ত দু’টি পা আছে রুখে দাঁড়াবার। তবে কেন ভয়? নাকি তোষামোদ করতেই কলম ধরেছো তোমরা?- ঠিকই বলেছেন। ব্যাপারটা লজ্জার!- শুধু কি তাই? কী করে তোমাদের যোগ্য উত্তরসুরী ভাববো?- ক্ষমা করবেন জনাব।কবি রেগে গেলেন। আমি দেখলাম তার অগ্নিমূর্তি। গায়ে জড়ানো চাদরটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলেন। কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ালেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে। আমি ভীত-সন্ত্রস্ত।- কাছে আসো।- জ্বী বলেন।- যে দেশে এত এত সম্ভাবনাময় তরুণ আছে। সে দেশে এত লেখক হত্যা হয় কীভাবে? বর্ষবরণে তরুণী লাঞ্ছিত হয় কীভাবে? চলন্ত গাড়িতে কিংবা মাইক্রোবাসে যুবতী ধর্ষিত হয়। এ কি কম লজ্জার?- ক্ষমা করবেন কবি।- কীসের ক্ষমা? ওরা কি ক্ষমা করবে তোমাদের?- এটাতো রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা।- সব ব্যর্থতা রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘাড়ে চাপালেই কি পার পেয়ে যাবে? কীসের তরুণ তোমরা? কীসের সাহিত্যসেবী। সাহিত্য মানেই কি শুধু নারীর আরাধনা। অসংগতির বিরুদ্ধে কথা বলবে কারা? তোমরা কবি-সাহিত্যিক নামধারীরা পদক, সম্মাননার পেছনে ছুটছো। দলবাজী আর গলাবাজী করে মনুষ্যত্ব হারাচ্ছো। তোমাদের আচরণে হতাশ হয়েই আমাকে আসতে হলো।- আপনি এসে আমাকে ধন্য করেছেন।- সে আমি জানি না। এক বুক আশা নিয়ে এসেছি। তুমি আমার কথা রাখবে?এবার কবির কণ্ঠে কাতরতা। চোখের কোণে জল। এইতো কবির চিরাচরিত রূপ। বিপ্লবের পরে কাতরতা, কাতরতার পরে বিপ্লব। বিদ্রোহের পরে প্রেম, প্রেমের পরে বিদ্রোহ। এতগুলো সত্ত্বা একজন মানুষ কীভাবে ধারণ করে? মাথা নিচু হয়ে এলো আমার।- বলুন, কী করতে হবে?- একটু প্রতিবাদী হও। যোগ্য হয়ে ওঠো। লেজুরবৃত্তি নয়, সত্যকে লালন করো।- জ্বি, করবো। দোয়া করবেন।- আসি তবে আজ। তুমি এই বিদ্রোহী নজরুলের ব্যথিত আত্মার আর্তনাদ সব কবি-লেখকের কাছে পৌঁছে দিও।- আমি কি পারবো এ গুরু দায়িত্বের ভার বহন করতে?- আত্মপ্রত্যয়ী হও। জাতির দুর্দিনে এগিয়ে আসো। আমি আবার আসবো।কবি দৃপ্ত পায়ে হেঁটে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। আমি তাকে চায়ের অফার করলাম। তিনি পিছন ফিরে তাকালেন না। সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত পায়ে নেমে গেলেন। আমি সিঁড়ির প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে পা ফেলতেই পিছলে পড়ে গেলাম। গড়াতে গড়াতে নিচে নেমে যাচ্ছি...।এসইউ/পিআর

Advertisement