ময়মনসিংহের নান্দাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ আহমেদের প্রত্যাহারের খবর পেয়ে থানায় ভিড় করেন দোকানিরা। দোকানে ওসির বড় অঙ্কের টাকা বাকি রয়েছে বলে দাবি করেন তারা। তবে দোকানিরা আসার আগেই ওসি নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে থানা ত্যাগ করায় তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান।
Advertisement
এ নিয়ে ওসির সঙ্গে কথা হলে তিনি দোকানের বাকি টাকা পরবর্তীতে পরিশোধ করে দেবেন বলে জানান।
জানা যায়, ওসি ফরিদ নান্দাইল থানায় যোগদানের পর থেকে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি। গ্রেফতার বাণিজ্য, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তুচ্ছ অভিযোগ রেকর্ডভুক্ত করা, সাংবাদিকের নামে মামলার হুমকিসহ দোকানিদের থেকে বাকি পণ্য নিয়ে টাকা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এসবের মধ্যেই তাকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রত্যাহারের খবর ছড়িয়ে পড়লে পাওনাদাররা বিচ্ছিন্নভাবে থানায় আসেন। কিন্তু থানায় এসে ওসিকে না পেয়ে টাকা না নিয়েই ফিরে যান দোকানিরা। এমন ঘটনায় আরও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
Advertisement
জানা যায়, নান্দাইল থানায় ওসি হিসেবে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর যোগ দিয়েছিলেন ফরিদ আহমেদ। তার সময়ে চুরি ছিনতাইসহ আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে পুরো উপজেলায় ইয়াবার কারবার, গ্রেফতার বাণিজ্য চলে নির্বিঘ্নে। মামলা নেওয়ার নামে বিচার প্রার্থীদের হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এমতাবস্থায় ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করার চিঠি পেয়ে শুক্রবার (১৪ মার্চ) ভোরে কর্মস্থল ত্যাগ করেন তিনি। ওসির কর্মস্থল ত্যাগের খবর দেরিতে পেয়ে কমপক্ষে ৩০ জন পাওনাদার বিচ্ছিন্নভাবে থানায় এসে না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
উপজেলা মহিলা দলের আহ্বায়ক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান তাহমিনা আক্তার রিপা জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর আমার স্বামী রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়াকে উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ জুয়েলের নেতৃত্বে তার লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে জখম করেন। এ ঘটনায় তখন মামলা করতে না পারলেও চলতি বছরের শুরুতে মামলা করি। আসামিদের পরিবারের লোকজন মামলা তুলে নিতে আমার ও আমার স্বামীর হাতেপায়ে ধরেছেন। অনেক কান্নাকাটি করেছেন। এমতাবস্থায় মানবিক কারণে আমার স্বামী মামলা তুলে নিতে স্ট্যাম্পে আপস মীমাংসা করেন। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হন ওসি। তিনি আপস মীমাংসার বিপক্ষে অবস্থান নেন। অথচ মামলা করার জন্য ওসি ফরিদ আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল। ফরিদ এই থানার সবচেয়ে বিতর্কিত ওসি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
নান্দাইল পৌর বাজারের ইসহাক মার্কেটের প্রাইম কালেকশনের মালিক মো. মোফাজ্জল হোসেন খান রেনু। তিনি বলেন, ওসি ফরিদ আমার দোকান থেকে বিভিন্ন সময় পরিবারের জন্য পোশাক নিয়েছেন। এছাড়া গত শীতের শুরুতে নিয়েছেন তিনটি কাশ্মীরি শাল। সব মিলিয়ে এক লাখ ৪ হাজার ২৫০ টাকা বকেয়া রয়েছে। ওসি প্রত্যাহার হয়েছে জানতে পেরে দ্রুত থানায় যাই। তখন তাকে থানায় পাওয়া যায়নি।
নান্দাইল সদরের সুবর্ণ ইলেক্ট্রনিক্সের মালিক ফরহাদ বলেন, আমার দোকান থেকে ফ্যানসহ বেশ কিছু মালামাল নিয়েছিলেন ওসি। গত এক বছর তার কাছে ১১ হাজার টাকা পাই।
Advertisement
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও পাঁচ জন জানান, তারা বিভিন্ন কারণে ওসিকে লাখের ওপরে টাকা দিয়েছেন। এখন উনাকে না পেয়ে হতাশ। তাদের মতো আরও অনেকেই টাকা পাবেন বলে থানায় এসে ফেরত গেছেন।
পাঁচটি মামলার বাদী উত্তর বানাইল গ্রামের আনোয়ার হোসেন, চরভেলামারী গ্রামের রফিক সিকদার, জামাল উদ্দিন ও জয়নাল মিয়া এবং দত্তগ্রাম গ্রামের সাইফুল ইসলাম জানান, ওসি ফরিদ উপজেলার চর বেতাগৈর ইউনিয়নের চরকোমড়ভাঙ্গা, চরওভেলামারী গ্রামের ৪টি, মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের দত্তগ্রাম এলাকার একটি, গাঙাইল ইউনিয়নের উত্তর বানাইল গ্রামের একটিসহ মোট ৫টি মামলা রেকর্ডভুক্ত করেন। এসব মামলা থেকে ৭৮ হাজার টাকা নেন। তাদের মধ্যে সবাই ১০ হাজার করে টাকা ওসি ফরিদের হাতে দিলেও চরভেলামারী গ্রামের জয়নাল মিয়া দুই বারে মোট ৩৮ হাজার টাকা দিয়েছেন।
এদিকে সম্প্রতি গরু চুরি করে পিকআপভ্যানে নিয়ে যাওয়ার খবরে তাদের পিছু নেন ওসি ফরিদসহ পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাদের ওপর হামলা করে চোর চক্র। এ ঘটনায় ওসির দেহরক্ষীসহ আরেকজন আহত হন। ঘটনার বিস্তারিত জানতে ওসি ফরিদের সরকারি নম্বরে কল দিলে তিনি সাংবাদিকদের ওপর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াসহ মামলার হুমকি দেন।
শুক্রবার (১৪ মার্চ) রাত সাড়ে ৮টার দিকে এসব বিষয়ে জানতে প্রত্যাহার হওয়া ওসি ফরিদ আহমেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার কাছে কয়েকজন টাকা পায়। কিছু কেনাকাটা করেছিলাম। টাকাগুলো পরিশোধ করে দেবো। কতজন কত টাকা পাবেন, এমন প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান তিনি।
গ্রেফতার বাণিজ্যসহ তুচ্ছ অভিযোগ রেকর্ডভুক্ত করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে ওসি ফরিদ আহমেদ বলেন, আমার বিরুদ্ধে সবগুলো অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। এভাবে আমি কারও থেকে টাকা নেইনি।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গৌরীপুর সার্কেল) দেবাশীষ কর্মকার বলেন, ওসির কাছে সাধারণ লোকজন টাকা পায়, এটি খুবই দুঃখজনক। এ বিষয়ে ওসির সঙ্গে কথা বলা হবে।
কামরুজ্জামান মিন্টু/এমএন/এমএস