মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের নতুন ২৫ শতাংশ শুল্ক নীতির ফলে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের দাম বাড়তে পারে, যা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন বা ১৫ হাজার কোটি ডলারের আমদানির উপর প্রভাব ফেলবে। এই সিদ্ধান্ত আমেরিকান অটোমোবাইল শিল্পসহ অন্যান্য খাতের মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্র তার মোট ব্যবহৃত স্টিলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আমদানি করে। কানাডা এই আমদানির ২০ শতাংশ সরবরাহ করে, যা যে কোনো দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপরই রয়েছে ব্রাজিল ১৬ শতাংশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৭ শতাংশ। অ্যালুমিনিয়ামের প্রধান সরবরাহকারী দেশও কানাডা।
মূল্য বৃদ্ধি ও শিল্পের উপর প্রভাব
জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান উলফ রিসার্চের একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নতুন শুল্কের ফলে স্টিলের দাম ২০২৪ সালের গড় মূল্যের তুলনায় ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে, আর এরই মধ্যে উচ্চ মূল্যের প্রবণতায় থাকা অ্যালুমিনিয়ামের দাম প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।
Advertisement
নোমুরা সিকিউরিটিজের গবেষক অনিন্দ্য দাসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের দামের ১০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ২০২৫ অর্থবছরে ফোর্ড মোটর ও জেনারেল মোটরসের পরিচালন লাভ ৩ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে, যদি তারা ক্রেতাদের উপর ব্যয় চাপিয়ে দিতে না পারে। টয়োটা মোটরের ক্ষতি হবে তুলনামূলকভাবে কম, প্রায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও উত্তর আমেরিকায় উৎপাদনকেন্দ্রিক জাপানি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সুবারুর জন্য এই প্রভাব হবে প্রায় ২ শতাংশ।
জাপানের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
জাপানের কিছু অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ নির্মাতা মার্কিন উৎপাদন কেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য জাপান থেকে স্টিল আমদানি করে, ফলে তাদের ব্যয়ও বাড়বে। এক টয়োটা নির্বাহী বলেন, শুল্ক আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তবে আমরা যথাযথভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব।
জাপান সরকার শুল্ক থেকে ছাড়ের দাবি জানিয়েছে। প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিমাসা হায়াশি বলেন, জাপান থেকে আমদানি করা স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর নয় বরং এই উচ্চমানের পণ্যগুলো মার্কিন শিল্প ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
Advertisement
বাজারের প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য বিকল্প
ইইউ-ভিত্তিক গ্লোবাল ট্রেড অ্যালার্টের তথ্য অনুযায়ী, নতুন শুল্ক ২৮৯টি পণ্যের উপর প্রভাব ফেলবে, যার মধ্যে রান্নার সরঞ্জাম ও ক্রীড়া সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত। ২০২৩ সালে এই পণ্যগুলোর মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১৫১ বিলিয়ন বার ১৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার, যা মার্কিন মোট আমদানির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
নতুন শুল্কের ফলে চীনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে, যার ৩৫ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য এই নীতির আওতায় পড়বে। এরপরে রয়েছে মেক্সিকো (৩০ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৬০ কোটি ডলার), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (২০ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০ কোটি ডলার) এবং কানাডা (১৭ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭১০ কোটি ডলার)। জাপানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোকে পৃথকভাবে গণনা করলে ২৭টি অর্থনীতির উপর ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের বেশি প্রভাব পড়বে।
বিকল্প বাজার ও শিল্পের প্রতিক্রিয়া
নতুন শুল্ক এড়াতে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানিকারকরা অন্যান্য বাজারে তাদের পণ্য বিক্রির চেষ্টা করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ান খনিজ উত্তোলনকারী রিও টিন্টো’র সিইও জ্যাকব স্টাওশলম বলেছেন, আমরা ইউরোপসহ অন্যান্য বাজারে অ্যালুমিনিয়াম বিক্রির সুযোগ খুঁজছি।
এদিকে, জাপানের লোহা ও স্টিল ফেডারেশনের চেয়ারম্যান তাদাশি ইমাই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, চীনের অতিরিক্ত রপ্তানির ফলে বাজারে যে মন্দা তৈরি হয়েছে, নতুন শুল্ক সেটাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
চীনের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশটি অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় বেশি স্টিল উৎপাদন করছে, যা কম দামে বৈশ্বিক বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়, তবে এসব পণ্য অন্যান্য দেশে প্রবাহিত হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে স্ক্র্যাপ লোহা ও স্টিলের বৃহত্তম রপ্তানিকারক, ফলে স্ক্র্যাপের উচ্চ মূল্য বৈশ্বিক বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। জাপানি অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনকারী ইউএসিজের এক কর্মকর্তা বলেন, স্বল্পমেয়াদে প্রভাব কম হবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
বিকল্প কাঁচামালের ব্যবহার বাড়ানোর প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরই মধ্যে কোম্পানিগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন উপকরণ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। যেমন কোকা-কোলা গত মাসে বলেছে যে, শুল্ক কার্যকর হলে তারা কিছু প্যাকেজিং অ্যালুমিনিয়াম থেকে প্লাস্টিকে পরিবর্তন করবে।
এই শুল্ক নিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ও বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানিগুলো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন কৌশল খুঁজছে।
সূত্র: নিক্কেই এশিয়া
এসএএইচ