বিশ্ব কিডনি দিবস আজ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচিতে দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর মার্চের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার এই দিবসটি পালিত হয়। দেশে কিডনি রোগের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। তাই প্রতিকারের পাশাপাশি কিডনি রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা খুবই জরুরি।
Advertisement
কিডনি মানবদেহের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বর্তমানে সাধারণ এবং জটিল কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমানোর জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ডায়াবেটিস রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যান্সার রোগীদের চেয়ে প্রায় বিশ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭ম স্থানে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দখল করে নেবে ৫ম স্থান। আবার উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে কিডনি রোগের হার সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ডায়াবেটিস রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যান্সার রোগীদের চেয়ে প্রায় বিশ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭ম স্থানে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দখল করে নেবে ৫ম স্থান।
Advertisement
বাংলাদেশেও কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক। তথ্য মতে, প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কিডনি রোগী ডায়ালাইসিসের উপর নির্ভরশীল হয়। শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আরো ২৪ থেকে ৩০ হাজার রোগী হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে সাময়িক ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়।
মানবদেহে কিডনি একটি ভাইটাল অর্গান। কিডনির কাজ হচ্ছে শরীরের দূষিত রক্ত শোধন করা। এছাড়া কিডনি অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তবে কিডনি যদি ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। কিডনির পাথর আরেকটি রোগ। তবে এটি খুব জটিল নয়। এখন সহজেই এটি নিরাময় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানি পান ও জগিং করা জরুরি। হঠাৎ করেও বিকল হতে পারে কিডনি। এর কারণ হতে পারে পানিশূন্যতা। যারা রোদে কাজ করেন ও পানি খাওয়ার সময় পান না, তাদের ক্ষেত্রে পানিশূন্যতার কারণে হঠাৎ কিডনি বিকল হতে পারে।
এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ খাওয়া, প্রস্টেট বড় হয়ে যাওয়া, কিডনিতে বেশি পাথর জমা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ ইউরিন ইনফেকশনের কারণে একদিনে হঠাৎ করেই কিডনি বিকল হতে পারে।
ক্যালসিয়াম ও অক্সালেটের সংমিশ্রণেই পাথরের সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থাৎ ৮০-৯০ ভাগ রোগীর কিডনিতে জমা পাথর নিয়মিত জীবনযাপনের মাধ্যমে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এজন্য দৈনিক আধা ঘণ্টা হাঁটা ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া জরুরি।
Advertisement
উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) এবং কিডনি রোগের মধ্যে একটি গভীর ও জটিল সম্পর্ক রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগের একটি প্রধান কারণ এবং আবার কিডনি রোগও উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। এই দ্বিমুখী সম্পর্কের কারণে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা কিডনি সুস্থ রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শতকরা ৩০ ভাগ উচ্চ রক্তচাপ রোগী কিডনি রোগে আক্রান্ত হন । উচ্চ রক্তচাপের সাধারণত কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ থাকে না। আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতি চার জনে ১ জনের উচ্চ রক্তচাপ আছে। অঙ্কুরেই নির্ণয় করার জন্য মাঝে মাঝে রক্তচাপ মাপতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ কিডনিকে কীভাবে ক্ষতি করে?১. রক্তনালীর ক্ষতি: উচ্চ রক্তচাপ কিডনির সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে। এই রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ ঠিকমতো ফিল্টার করতে পারে না।২. ফিল্টারেশন ক্ষমতা হ্রাস: কিডনির গ্লোমেরুলি (ছাঁকনি) ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রোটিন প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায় (প্রোটিনিউরিয়া) এবং কিডনির কার্যকারিতা কমে যায়।৩. কিডনি ফাইব্রোসিস: দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ রক্তচাপ কিডনির টিস্যু শক্ত ও দাগযুক্ত (ফাইব্রোসিস) করে তোলে, যা কিডনির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট করে।
কিডনি রোগ উচ্চ রক্তচাপের কারণ কীভাবে?কিডনি শরীরের তরল ও লবণের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং রেনিন নামক একটি হরমোন নিঃসরণ করে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কিডনি রোগ হলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এটি একটি চক্র তৈরি করে, যেখানে উচ্চ রক্তচাপ কিডনি ক্ষতি করে এবং কিডনি রোগ আবার উচ্চ রক্তচাপ বাড়ায়।
কিডনি সুস্থ রাখতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কেন জরুরি?১. কিডনি ক্ষতি রোধ: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে কিডনির রক্তনালীগুলোর ক্ষতি কমে এবং কিডনির কার্যকারিতা দীর্ঘস্থায়ী হয়।২. প্রোটিনিউরিয়া প্রতিরোধ: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে প্রস্রাবে প্রোটিন লিক হওয়ার ঝুঁকি কমে, যা কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।৩. কিডনি ফেইলিউর প্রতিরোধ: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে কিডনি সম্পূর্ণরূপে বিকল হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়।৪. হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস: উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনি রোগ উভয়ই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে।
কিডনি সুস্থ রাখতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়:১. লবণ কম খান: দিনে ৫ গ্রাম (১ চা চামচ) এর কম লবণ খান।২. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য এবং কম চর্বিযুক্ত খাবার খান।৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন।৪. নিয়মিত ব্যায়াম: সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি ধরনের ব্যায়াম করুন।৫. ধূমপান ত্যাগ: ধূমপান রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রক্তচাপ বাড়ায়।৬. ওষুধ সেবন: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ACE inhibitors বা ARBs জাতীয় ওষুধ সেবন করুন, যা কিডনি রক্ষায় বিশেষভাবে কার্যকর।৭. নিয়মিত চেকআপ: রক্তচাপ ও কিডনি ফাংশন নিয়মিত পরীক্ষা করুন।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে কিডনি রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায় এবং কিডনির স্বাস্থ্য দীর্ঘমেয়াদি ভাবে সুরক্ষিত থাকে।
লেখক : এমবিবিএস, এমডি (নেফ্রো), এফসিপিএস (মেডিসিন), এফআরসিপি। সভাপতি, কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস)। অধ্যাপক, কিডনি রোগ বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
এইচআর/এএসএম