একুশে বইমেলা

ঈশ্বর ও হেমলক: প্রেম ও ইতিহাসের মেলবন্ধন

তর্ণিকা হাজরা

Advertisement

নতুন প্রজন্মের লেখক সাজেদুর আবেদীন শান্ত। তিনি একাধারে সাংবাদিক, সম্পাদক, লেখক এবং কবি। কবিতাপ্রেমী এই তরুণের লেখা তৃতীয় কবিতার বই ‘ঈশ্বর ও হেমলক’ এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। যা প্রকাশ করেছে উন্মেষ প্রকাশন। প্রেম, অন্তর্দাহ, বিরহ, দেশজ অন্যায় এবং সাময়িক ঘটনাবলির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে এ গ্রন্থে। যা পাঠককে আনন্দিত করবে, আন্দোলিত করবে, স্মৃতিকাতর করবে তার পুরোনো প্রেমকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে। বইটির বিষয়ের তাৎপর্য এবং গদ্যছন্দ আমাকে আকৃষ্ট করেছে বইটি বারবার পাঠ করার জন্য। যে কোনো কবিতাপ্রেমী পাঠকমাত্রই বইটির প্রেমে পড়তে বাধ্য হবেন।

‘ঈশ্বর ও হেমলক’ শুরু হয়েছে ‘মহামান্য জীবনানন্দ’ নামের একটি কবিতা দিয়ে। যা মূলত তরুণ কবি শান্তর অন্তরের স্বীকারোক্তি। একজন প্রকৃত কবির কবিতা জন্ম দেওয়ার যে বেদনা, তা যেন কবিতাটির ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটির লাইনে লাইনে ফুটে উঠেছে তার কবি হয়ে ওঠার বেদনা। তার কবি হয়ে ওঠার অন্তরের আকুলতা। তার কবিতা সৃজনের প্রতি মমতা। কবির ভাষায়,‘আমি কাশতে থাকি/ কাশতে কাশতে গলা ফেটে রক্ত আসে/ মহামান্য জোর দিতে থাকেন/ বলেন এই বের হবে, আরেকটু/ তাহলেই গলা দিয়ে বের হবে/ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (মহামান্য জীবনানন্দ)। এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা দিয়ে বইটি শুরু হওয়ায় পেয়েছে বিশেষ মর্যাদা। যাতে তরুণ কবি শান্তর সুগভীর অনুভব প্রকাশিত।

কবি সাজেদুর আবেদীন শান্তর কবিতার পরিসীমা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সুদূর বৈশ্বিক গণ্ডিতে ছড়িয়ে পড়েছে। তা শুধু দেশ কিংবা দেশের কবিদের অনুভবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি তার কবিতায় কথা বলেছেন পৃথিবীর বিখ্যাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনি নিয়ে। তিনি পাঠকদের নিয়ে গেছেন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে। এ আলোচনা তার কবিতার বিষয়বস্তুতে অভিনবত্ব এনেছে—‘হিরোশিমা-নাগাসাকিতে—/ আবারও যদি বিস্ফোরিত হয় বোমা/ পৃথিবী যদি ভরে যায় পারমাণবিক কণায়—/ আমার কিছুই করার থাকবে না।’ (তোমাকে ছুঁতে না পারার ব্যর্থতা)

Advertisement

তার এ রচনা শুধু আয়তনের পরিসীমাকে প্রকাশ করে না। ইতিহাস জ্ঞানের গভীরতাকেও প্রকাশ করে। কবির কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত যে ভাব; তা আসলেই চমকপ্রদ। কবিতা পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হয় সেই ইতিহাসের প্রাচীন জগতে। যার কাব্যিকতা মানবকে করে সচকিত। এ কবিতায় কবির অপরিসীম প্রেমের সাথে প্রকাশ পেয়েছে ইতিহাসের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন।

কবি সাজেদুর আবেদীন শান্ত বাস্তবতার কাছে পুরোপুরি সমর্পিত; যার প্রকাশ ঘটেছে তার একাধিক কবিতায়। অবলীলায় প্রকাশ করেছেন যে, মানুষের জীবনে প্রেম বহুবার আসে। আমরা যদিও বলি, মানুষ প্রকৃতপক্ষে প্রেমে পড়ে একবার কিন্তু কথাটি আসলে পুরোপুরি সত্য নয়। প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রেম আসে একাধিকবার, এমনকি বহুবার। যার প্রকাশ ঘটেছে তার বিখ্যাত কবিতা ‘বহুগামী’তে। ‘বহুগামী’ কবিতাটি আমার মনকে করেছে চমকিত। পাঠকমাত্রই কবিতাটি পাঠ করার পরে তার সাথে নিজের একাত্মতা অনুভব করবেন। প্রথম প্রেম ভোলা যায় না—এ প্রচলিত অসত্য কথা সাহসিকতার সাথে প্রকাশ করেছেন এ কবিতায়—‘তুমি পাশে বসতেই ভুলে গেলাম/ আমার গেল জন্মের পাপ/ তোমার হাত ছুঁয়েই ভুলে গেলাম/ অতীত প্রেমিকার কথা।/ কেবলই মনে হতে থাকা/ একশ একটি প্রথম প্রেম তুমি/ যাকে আঁকড়ে ধরে বলতে পারব/ অতীতের ভালোবাসা ভুলে গেছি আমি। (বহুগামী)

আরও পড়ুনপ্রেম কিংবা রক্ত-ঝরা কবিতাবই পড়তে গিয়ে অনেক চরিত্রের প্রেমে পড়েছি: নির্জন

বিচক্ষণ কবি এ কবিতায় দেখিয়েছেন যে, মানুষ কীভাবে আসলে একের পর এক প্রেমে পড়ে এবং প্রতিটি প্রেমই হয়তো তার কাছে মনে হয় বাস্তব। একপর্যায়ে এসে সঠিক মানুষের সন্ধান পেয়ে সে ভুলে যায় তার আগের সব প্রেম। এমনকি সেটি যদি হয় প্রথম প্রেম, তবুও এই নতুন বাস্তব প্রেমের ছোঁয়া ভুলিয়ে দেয় প্রথম প্রেমের সব স্মৃতি।

Advertisement

‘নাবা’ কবির অন্য একটি অসাধারণ সৃষ্টি। জীবনের কোনো কোনো স্মৃতি জমে থাকে মনের কোণে, তাকে মানুষ সচেতনভাবে আগলে রাখে, বুকে জড়িয়ে রাখে, সযতনে বাঁচিয়ে রাখে। মানুষটিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় গোটা জীবন ধরে। কিন্তু নিয়তির নির্মমতা তা হতে দেয় না—এ চরম সত্যকে করুণভাবে দেখিয়েছেন ‘নাবা’ কবিতায়। কবি বলেছেন, ‘তুমি চলে গেলে, সময় থেমে থাকল না,/ শুধু স্মৃতির ক্যানভাসে আঁকা রইলে তুমি।/ নাবা, তুমি কি জানো?/ সেই একদিনের দেখা/ তোমার সেই চিরন্তন হাসি/ অনুভূতির মতো থেকে গেল,/ যা কখনো মুছে যাবে না।’

এ কবিতায় কবি সুকৌশলে তার কবিতা লেখার অনুপ্রেরণাকেও প্রকাশ করেছেন। তিনি সেই ক্ষণিকের পরিচিতাকে নিজের মনে কীভাবে ধারণ করেন, তা এ লাইনে প্রকাশিত—‘তোমার হাসি, তোমার চোখ, সব যেন আমার কবিতার প্রতিটি শব্দে বাঁচে।’

সমাজ ও রাষ্ট্র সচেতন কবি রাষ্ট্রের ওপর নিজের দায়িত্ব পালনেও এড়িয়ে যাননি। সাময়িক অবস্থায় তিনি বিপর্যস্ত। তিনি নিজের যে বিধ্বস্ত অবস্থা, নিজের যে শান্তিরহিত অবস্থা—তা প্রকাশ করেছেন ‘ঘুমাবো’ কবিতায়। তিনি ঘুমাতে পারছেন না নানা কারণে। তিনি ঘুমাতে পারছেন না নারীর ওপরে হওয়া ধর্ষণের মতো কাহিনির নির্মমতায়। তিনি তার মর্মাহত অবস্থাকেও প্রকাশ করেছেন। কবির ভাষায়, ‘আমি ঘুমাব/ জেগে থেকে লাভ কী?/ ভয় শুধু লাঞ্ছনার/ সিমি, তনু, নুসরাত/ শারমিন ঘুমালে হয়তো/ তাদের সম্ভ্রমহানি হতো না’ (ঘুমাব)

কবির সর্বশেষ কবিতা ‘ঈশ্বর ও হেমলক’। এতে ব্যক্তিগত অনুভূতির সুগভীর প্রকাশ ঘটেছে যা আমাদের ভাবিত করে। কবিতাপ্রেমী পাঠকের জন্য অবশ্য পাঠ্য বইটি। বইটি বাংলা কাব্যজগতের মূল্যবান সংযোজন। আমি সময়ের নবীন কবি সাজেদুর আবেদীন শান্ত ও তার কবিতার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি।

বই: ঈশ্বর ও হেমলককবি: সাজেদুর আবেদীন শান্তপ্রকাশনী: উন্মেষ প্রকাশনপ্রচ্ছদ: আর করিমমূল্য: ১০০ টাকা।

এসইউ/জেআইএম